লিবিয়ায় নির্মম নির্যাতনের শিকার মাদারীপুরের রাকিবের মৃত্যু
মাদারীপুর ও টেকেরহাট প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:১১ এএম
উন্নত জীবনের আসায় ইতালিতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন মাদারীপুর সদরের রাকিব মহাজন। তিন বছর লিবিয়ায় দালাল চক্রের অমানবিক নির্যাতনে অবশেষে মারা গেছেন বলে খবর পেয়েছে তার পরিবার। সেই খবরে নিহতের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে বাবা-মা, ভাই-বোনসহ পাড়া-প্রতিবেশীরা।
বুধবার রাতে রাকিব মহাজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন তার পরিবার। রাকিব মহাজন মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াজপুর ইউনিয়নের পখিরা গ্রামের নাজিম উদ্দিন মহাজনের ছেলে। এদিকে প্রশাসন থেকে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার নিহত রাকিবের বাড়িতে গেলে পরিবারের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, তিন বছর আগে মাদারীপুর সদর উপজেলার ফটিক মৃধার ছেলে জাহাঙ্গীর মৃধার প্রলোভনে পড়েন রাকিব মহাজন।
জাহাঙ্গীর মৃধা তার ভায়রা শরীয়তপুরের পালং থানার ধানুকা ইউনিয়নের ছোট বিনোদপুর গ্রামের সোহাগ মাতুব্বরের মাধ্যমে ২৭ লাখ টাকায় ইতালিতে পৌঁছে দেওয়ার চুক্তি করে।
চুক্তি অনুযায়ী, ২৭ লাখ টাকা দিয়ে তিন বছর আগে রাকিব পাড়ি জমান লিবিয়ায়। তবে লিবিয়া নেওয়ার পরে সেখানে আটক রেখে আরও টাকার জন্যে নির্যাতন চালাতে থাকে সোহাগ মাতুব্বর। পরে রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন ধার-দেনা করে আরও ৫ লাখ টাকা দেন সোহাগকে। তাতেও কাজ হয়নি। লিবিয়ায় দুই বছর চার মাস অসহ্য যন্ত্রণা-নির্যাতন সহ্য করে কাটিয়েছে রাকিব।
আরও জানা গেছে, দুই বছর চার মাস পরে সোহাগের পরিবর্তে আরেক দালাল সদর উপজেলার ঝাউদি ইউনিয়নের ব্রাহ্মন্দী গ্রামের মাজেদ খলিফাকে ধরে রাকিবের পরিবার। তাকেও ৮ মাস আগে ১৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়; কিন্তু তিনিও টাকা নিয়ে সেখানেই নির্যাতন চালান সোহাগকে। একপর্যায়ে রাকিব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে লিবিয়ার একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। দালাল মাজেদ খলিফাই রাকিবের মৃত্যুর খবর তার পরিবারকে জানান। স্বজনের কাছে প্রাণহীন দেহের কয়েকটি ছবি-ভিডিও পাঠিয়ে দেন। তার মৃত্যুতে পুরো পরিবারসহ এলাকাবাসীর মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
নিহত রাকিবের বাবা নাজিম উদ্দিন মহাজন জানান, দফায় দফায় টাকা দিয়ে আমি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। এ পর্যন্ত সোহাগ আর মাজেদকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়েছি। তারপরে এখন আমার ছেলের মৃত্যুর খবর শুনতে হলো। আমার ছেলেকে না খাইয়ে মেরে ফেলেছে। কয়েকদিন আগেও আমার ছেলে ভিডিওতে তার নির্যাতনের কথা বলেছে। আর বাঁচার জন্যে আকুতি করেছে। ছেলেকে বাচাতে পারলাম না।
নির্যাতনে রাকিবের মৃত্যুর জন্য দোষীদের বিচার দাবি করেন পরিবার ও এলাকাবাসী। তারা রাকিবের লাশ দেশে আনারও দাবি জানান। নিহতের ছোট চাচা শাহজালাল মহাজন বলেন, নির্যাতন করে আমার ভাতিজাকে হত্যা করেছে। এখন দালালরা বলে অসুস্থ্য হয়ে রাকিব মারা গেছে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই। এভাবে যেন আর কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় দালাল জাহাঙ্গীর মৃধা বলেন, সোহাগ আমার ভায়রা বিধায় আমাকে জড়ানো হচ্ছে। কেউ বলতে পারবে না যে আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। আর ওই ছেলে অসুস্থ হয়ে লিবিয়ায় মারা গেছে। আমার ভায়রা বরং সেখানে ট্রিটমেন্ট করেছে। এর বেশি কিছু জানি না।
মাজেদ খলিফার বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়রা বলেছেন, মৃত্যুর বিষয়টি জানার পরে তার পরিবার বাড়ি থেকে পালিয়েছে।
এদিকে মাদারীপুর জেলা পুলিশের তথ্যমতে, গেল বছর লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে মাদারীপুর জেলার অন্তত শতাধিক মানুষ মারা গেছে। এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক দালালের বিরুদ্ধে প্রায় ২০০ মামলা হয়েছে; কিন্তু মামলায় জামিন পেয়ে পুনরায় দালালিতে যুক্ত হয় তারা।
পুলিশ সুপার মো. সাইফুজ্জামান বলেন, বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি মাদারীপুরের দালাল চক্রের বিরুদ্ধে। আমরা জেলা পুলিশ এসব বিষয়ে জিরো টলারেন্সে আছি।
একটি সূত্র জানায়, মাদারীপুরে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে লিবিয়া হয়ে ইতালিতে মানবপাচার করছে প্রতারক চক্র। এতের মদদ দিচ্ছে রাজনৈতিক একটি মহল। ফলে ধরা-ছোঁয়ার বাহিরেই রয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র।