ছাত্র আন্দোলনে ডান চোখ হারানো রাজমনির বাম চোখ বাঁচানোর আকুতি
মো. জাকির হোসেন ও লুৎফুজ্জামান লিটন, টঙ্গী (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে টঙ্গীতে পুলিশের ছোড়া টিয়ারশেলের আঘাতে ডান চোখ হারিয়েছেন পোশাক শ্রমিক রাজমনি আক্তার (৩৩)। সেই সঙ্গে বাম চোখের চিকিৎসায় যা সম্বল ছিল সব খরচ করে চেষ্টা করেছেন। চোখের সমস্যায় পোশাক কারখানায় কাজ হারিয়েছেন বিধবা রাজমনি। সবশেষে হাত পেতেছেন মানুষের দ্বারে।
রাজমনি শেরপুর জেলার শ্রীবর্দী থানার ফিরোজপুর গ্রামের আব্দুল আজিজের মেয়ে। তার মেয়ে উর্মি পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তিনি গাজীপুর এলাকার সালাহউদ্দিনের ভাড়া বাসায় বসবাস করে টেকবান লিমিটেড নামক পোশাক কারখানায় অপারেটর (আইডি নং-১৫০২৭) পদে চাকরি করতেন।
চোখ হারানো রাজমনি আক্তার বলেন, ২০ জুলাই রাজপথে ছাত্র-জনতার স্লোগানে কারখানায় স্থির থাকতে পারছিলাম না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে একাত্মতা পোষণ করে কারখানার নিরাপত্তা প্রহরীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে গাজীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেই। এক দফ এক দাবি, খুনি হাসিনা তুই কবে যাবি- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকি।
তিনি জানান, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতা বারবার বাধা দিচ্ছিল তাকে; কিন্তু তিনি চলে যাননি। বিকাল সাড়ে ৩টায় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার সঙ্গে যখন রাজমনি স্লোগানে ব্যস্ত ঠিক তখনই আচমকা শুরু হয় আক্রমণ, মুহুর্মুহু গুলি ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ। মুহূর্তের মধ্যে মহাসড়ক রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। অনেকে গুলির আঘাতে লুটিয়ে পড়েন মহাসড়কে। ছোটাছুটি করতে থাকেন অনেকে। হঠাৎ টিয়ারশেলের একটি ক্ষুদ্র কণা এসে রাজমনির ডান চোখে আঘাত করে।
তিনি লুটিয়ে পড়েন মহাসড়কে। আহত রাজমনিকে তার সহযোদ্ধারা উদ্ধার করে নিয়ে যান নিকটস্থ একটি ফার্মেসিতে। পল্লী চিকিৎসক তাকে পাঠিয়ে দেন গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানে তিনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাননি।
পরদিন ২১ জুলাই চিকিৎসার জন্য যান টঙ্গীর গুটিয়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও রাজমনিকে উপযুক্ত চিকিৎসা না দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর অসহায় রাজমনি যান তার কর্মস্থল গাজীপুরে টেকবান লিমিটেড কর্তৃপক্ষের কাছে। সেখানে কারখানা কর্তৃপক্ষ তার কাছ থেকে জোরপূর্বক সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে আইডি কার্ড রেখে তাকে বের করে দেন। আজ পর্যন্ত তাকে কারখানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।
২২ জুলাই রাজমনির ছোট ভাই স্বপনসহ স্বজনরা তাকে চিকিৎসার জন্য উত্তরা মক্কা আই হসপিটালে নিয়ে যান। সেখান থেকে চিকিৎসক রাজমনিকে ঢাকা ইস্পাহানি ইসলামিয়া আই ইন্সটিটিউট অ্যান্ড হসপিটালে স্থানান্তর করেন। ওই হাসপাতালের চিকিৎসক রাজমনির ডান চোখ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুবার অপারেশন করেন; কিন্তু রাজমনির চোখের আলো ফিরে আসেনি।
বরং অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় তার বাম চোখের আলোও নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। চোখের চিকিৎসায় তিনি তার সহায়-সম্বল যা কিছু ছিল সবকিছু শেষ করেছেন। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক টাকা ঋণ করে চিকিৎসা ব্যয় বহন করেছেন। বর্তমানে অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। কর্মহীন রাজমনি তার চোখ হারানোর বেদনা ও একমাত্র এতিম মেয়ের ভবিষ্যত চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
আবেগাপ্লুত ও আক্ষেপের কণ্ঠে বিধবা রাজমনি জানান, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে চাকরি হারালাম, ডান চোখ হারালাম, চিকিৎসায় সর্বস্ব হারালাম, এখন বাম চোখও হারাতে বসেছি। আজ আমি নিঃস্ব, নিপীড়িত ও বঞ্চিত। সবার বাধা ডিঙিয়ে আন্দোলনে অংশ নেওয়া কি আমার অপরাধ ছিল? কেউ কোনো সহায়তা করা তো দূরের কথা, একটিবারের জন্যও কেউ এসে একটু খোঁজখবরও নেয়নি। এতটাই পোড়া কপাল আমার! বাম চোখটিও নষ্ট হয়ে গেলে তো দুনিয়ার আলো দেখতে পাব না'।