পচাগলা লাশ নিয়েই জীবন চলে ছকু মিয়ার
সিদ্দিক আলম দয়াল, গাইবান্ধা
প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৭:৫০ পিএম
পচাগলা, ফাঁসিতে ঝুলন্ত, দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির লাশ ঘাড়ে নিয়ে সোজা ভ্যানে তুলে নিয়ে চলে যান গন্তব্যের টানে। বিচিত্র পেশার মানুষ ছুকু মিয়া।
গভীর রাতে পুলিশের ফোন পেলে একাই ভ্যান নিয়ে ছুটে যান যেখানে ডাক পড়ে। তারপর মরা পচাগলা মানুষের দেহ এক টানে ঘাড়ে তুলেন। লাশ ভ্যানে তুলে নিয়ে সোজা হাসপাতাল মর্গে।
ঝুলন্ত আর গলিত লাশ নিয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন তিনি। বললেন- পচাগলা ও ফাঁসিতে ঝোলানো লাশ দেখে সবাই দূরে চলে যায় ভয়ে। আর আমি একাই তার লাশ ঘাড়ে করে তুলে নিয়ে যাই।
লাশ টানা ছাড়া অন্য কাজ করতে পারে না ছকু মিয়া। বুকে সাহস আছে বলে এই পচাগলা আর ফাঁসিতে ঝোলানো লাশ নিয়ে কারবার তার। এখন পেশা হিসেবে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। পলাশবাড়ি, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গাইবান্ধা সদর থানা এলাকায় কারো অপমৃত্যু হলেই ডাক পড়ে ছকু মিয়ার। লোকে তাকে লাশ টানা ছকু হিসেবে জানেন।
স্ত্রী রেখা বেগম বলেন, কোথাও পচা লাশ পড়ে আছে- খবর পেলেই পুলিশ গিয়ে হাজির হয় ছকুর বাড়িতে। নয়তো ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। তারপর ভ্যান নিয়ে ছকু মিয়া হাজির লাশের পাশে।
ছকু মিয়া বলেন, মরা মানুষের লাশের খুব গন্ধ হয়। তারপরও বাধ্য হয়েই মরা-পচা, গলিত, ফাঁস লাগানো, কবর থেকে গন্ধযুক্ত লাশ তোলার কাজ করতে হয়। এক সময় মরা, পচা, গলা, ঝুলন্ত মানুষের লাশ দেখে খুব ভয় হতো; কিন্তু এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।
গাইবান্ধা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে বল্লমঝাড় ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রাম। এই গ্রামের রাস্তার পাশে টিনের দোচালা ঘর ছকু মিয়ার। সংসারে অভাবের কারণে ছোটবেলায় স্কুলে যেতে পারেনি। জমিতেও কাজ করতে পারে না। ১৪-১৫ বছর বয়সেই বিয়ে করেন রেখা নামের এক নারীকে। তারপর অভাব আরও জেঁকে বসে তার ওপর। অভাবের তাড়নায় খুঁজতে থাকেন কাজ। পরিচয় হয় থানা পুলিশের সঙ্গে। তাদের পরামর্শে ৩৫ বছর আগে থেকে লাশ টানার কাজ জোটে তার কপালে। প্রথম প্রথম মরা মানুষ দেখলে ভয় লাগত; কিন্তু এই পেশা ছেড়ে দিলে ভাত জুটবে কোথা থেকে। এর মধ্যে এক ছেলে ফিরোজ ও মেয়ে শরিফার জন্ম হয় তার সংসারে। স্ত্রী সন্তান মিলে ৪ জনের সংসার।
তিনি বলেন, পচা লাশ দেখে আর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে থাকা বীভৎস লাশ দেখে আশপাশের লোকজন সবাই দূরে সরে যায়, অস্ত্রধারী পুলিশও; কিন্তু আমি একাই ফাঁসির ঝুলন্ত লাশ বুকে নিয়ে নিচে নামিয়ে আনি। অনেক সময় লাশের শরীরের পায়খানা প্রস্রাব তার গায়ে লাগে; কিন্তু কি আর করা? মাটিতে পড়ে থাকা কয়েক দিনের পচা লাশ দুই হাত দিয়ে তোলেন, তারপর তার ভ্যানে তুলে সোজা পুলিশের কথামতো মর্গে।
তিনি বলেন, ঝুলন্ত লাশ মাটিতে নামিয়ে মর্গে পৌঁছে দেওয়া এবং তারপর ঠিকানামতো পৌঁছে দিলে তাকে কেউ দেয় ৩-৪ হাজার টাকা। আর কবর অথবা মাটি থেকে পচা গলিত লাশ তুলতে দেয় ৪ হাজার টাকা। আর অল্প সময়ের মরা মানুষের দেহ মর্গে নিয়ে যাওয়া ও ঠিকানামতো পৌঁছে দিলে তাকে অন্তত ২ হাজার টাকা দিতে হয়।
এই কাজের জন্য মজুরি হিসেবে যা পায় তাতে তার পরিবারের মুখে দুই বেলা খাবার জোটে কোনোমতে। লাশ নাই, তো কাজ নাই। লাশের অপেক্ষায় সারা মাস বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। পুলিশের কাছে তার ফোন নম্বর থাকলেও সরকারি খাতায় তার নাম নেই।
গাইবান্ধা সদর থানার ওসি শাহীনুর রহমান তালুকদার জানান, লাশ টানার কাজ কেউ করতে চায় না, ভয়ে মরা মানুষের থেকে দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে মানুষ। আমি মনে করি একটি মহৎ কাজের সাথে জড়িত। ফাঁসির বীভৎস লাশ থেকে শুরু করে, পড়ে থাকা পচা গলা একটি মরদেহ তিনি হাতে নিয়ে বহন করেন। এমন সাহস কার আছে? আর এ কাজও কেউ করতে চায় না। সে কারণে ছকু মিয়ার পাওনা আরও অনেক বেশি হওয়া উচিৎ।