বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন
নড়াইলের গুলিবিদ্ধ সোহান বিনা চিকিৎসায় ভুগছেন

মো. শাহীদুল ইসলাম শাহী, নড়াইল
প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৭ এএম

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে আহত হন সোহান বিশ্বাস
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছররা গুলিতে আহত হন নড়াইল সদরের বাঁশগাম ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মতিয়ার রহমান বিশ্বাসের ছেলে সোহান বিশ্বাস (২৮)। গুলিবিদ্ধ বাম হাতের যন্ত্রণায় তিনি রাতে ঘুমাতে পারেন না। গুলিতে তার বাম হাতের রক্ত চলাচলকারী ধমনী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাতের স্বাভাবিক অবস্থা ফেরাতে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করেছেন। কিন্তু সেটি এখনো স্বাভাবিক হয়নি এবং তার সারা শরীরে রয়েছে অসংখ্য গুলি। অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পারায় ধীরে ধীরে হাতটি তার অচল হওয়ার পথে।
সোহানের সংসারে অভাব থাকায় ৮ম শ্রেণির পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। আয়ের একমাত্র উৎস বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিছানায়। এ কারণে ৬ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট হয়েও পরিবারকে সহযোগিতা করতে প্রথমে রাজমিস্ত্রির সহকারী হিসাবে কাজ নিয়েছিলেন। তার সামান্য উপার্জনে চলত টানাটানির সংসার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সেই আয়ের পথও এখন বন্ধ। শনিবার প্রকাশিত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকায় ১১ হাজার ৫৫১ জনের মধ্যে সোহান বিশ্বাসের নাম রয়েছে ৮ হাজার ৩৪২ নম্বরে।
সোহান বিশ্বাস যুগান্তরকে জানান, ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হওয়ার পর রংপুরসহ সারাদেশ আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ৪ আগস্ট সোহান নড়াইলের মাদ্রাসা বাজার থেকে মিছিলে অংশ নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পৌর শহরের দিকে ধাবিত হন। মিছিলটি মাদ্রাসা বাজারের পশ্চিম পাশে ফিলিং স্টেশনের সামনে পৌঁছলে ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ পুলিশ ছররা গুলি ছোড়ে। মিছিলের সামনে থাকায় সোহানের বুকের বাম পাশে, বাম হাত, পেটে ও পায়ে দুই শতাধিক গুলি লাগে। বিশেষ করে বুকের বাম পাশে এবং পুরো বাম হাত জুড়ে এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গুলি লাগেনি। সেখানে থাকা অন্য আন্দোলনকারীরা অচেতন ও রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে প্রথমে লোহাগড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে দ্রুত খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। সেখানে ভর্তির পর অবস্থা গুরুতর হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তার শরীরে অস্ত্রোপচার করা হয়। মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ বাম হাতে একবার অস্ত্রোপচার করা হলেও সচল করা সম্ভব হয়নি। গুলি বের করতে হলে উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। পরিবার সামর্থ্য অনুযায়ী তার চিকিৎসা চেষ্টা করেছে। কিন্তু এ চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন কমপক্ষে ১০-১২ লাখ টাকা। সেই টাকার জোগান দেওয়া দিন মজুর পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়।
বর্তমানে সোহানের বুকের বাম পাশ, বাম হাত ও পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে দুই শতাধিক গুলি রয়েছে। সোহানের বাম হাতের নার্ভ এবং রক্তনালিতে গুলি থাকায় হাতটি অকেজো হওয়ার পথে উল্লেখ করে তার চাচা নড়াইল সদর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ওয়াহিদুজ্জামান বিশ্বাস বলেন, ‘সব শেষে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়েছে। ওর উন্নত চিকিৎসার জন্য ১০-১২ লাখ টাকা প্রয়োজন। এ পর্যন্ত ৩-৪ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু কোথাও থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। শুধু ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের একটি সংগঠন মাত্র ১০ হাজার টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছে। তাই সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা হলে ভাতিজার হাতটি ভালো হয়ে যেতে পারে। তা না হলে হয়তো চিরদিনের মতো অকেজো হয়ে যাবে।’
আক্ষেপ করে গুলিবিদ্ধ সোহান বলেন, ‘প্রতিদিনই ছাত্রদের আন্দোলন দেখতাম। চোখের সামনে এসব দেখে আর ঠিক থাকতে পারিনি। মনের টানে আন্দোলনে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ হই। শরীরে দুই শতাধিক ছররা গুলি রয়েছে। এখন দুর্বিষহ জীবনযাপন করছি। যন্ত্রণায় রাতে ঘুমাতে পারি না। একবার সহায়-সম্বল সবকিছু বিক্রি করে বাম হাতের অস্ত্রোপচার করেও অবশতা কাটেনি। বলা চলে বাম হাতটি এখন অচল। আরও অস্ত্রোপচারসহ উন্নত চিকিৎসা করা দরকার। এখন কেউ আমার খোঁজ নেয় না। আমি অনুদান নয়, উন্নত চিকিৎসা চাই।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নড়াইল জেলা সমম্বয়ক (ছাত্র প্রতিনিধি) রাফায়েতুল হক তমাল জানান, ‘আমরা শুধুমাত্র জেলায় আহতদের তালিকা তৈরি করে কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা ইতোমধ্যে প্রকাশ করেছে গণ-অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল। তালিকা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে সবাই জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আর্থিক সহায়তা পাবেন।’