সাভারে বিক্রিত প্লট দখল করে ভবন নির্মাণের অভিযোগ ‘ভূমিদস্যু’ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে
জাভেদ মোস্তফা, যুগান্তর প্রতিবেদন (ঢাকা উত্তর)
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:২৬ পিএম
সাভারের হেমায়েতপুরে সুগন্ধা হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ‘ভূমিদস্যু’ খ্যাত জাহাঙ্গীর আলম জিতুর বিরুদ্ধে তাদেরই বিক্রিত আড়াই কোটি টাকা মূল্যের প্লট দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযোগকারী প্লট মালিক রংপুরের ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল বেঙ্গল। তিনি জানান, ১৯৯৭ সালে এই হাউজিংয়ের একটি সোয়া ৮ শতাংশ জমি ক্রয় করেন তিনি, যা হাউজিংয়ের নকশায় ব্লক এ-এর ১০ নম্বর চিহ্নিত প্লট। অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলমের পিতা হাজী মো. আলম চাঁন সাব-কবলা দলিলের মাধ্যমে প্লটটি বিক্রি করেন। তবে ২০১৭ সালে ক্রেতা মোস্তফা কামাল বেঙ্গল জানতে পারেন যে, তার প্লটটি দখল করে ভবন নির্মাণের সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। পরে খবর নিয়ে জানতে পারেন, জাহাঙ্গীর আলম সেই জমি দখল করে সেখানে বহুতল ভবন নির্মাণ করবেন। এ খবর জেনে ক্রেতা মোস্তফা কামাল বেঙ্গল বিষয়টি সমাধানে বিক্রেতা আলম চাঁনকে জানান।
মোস্তফা কামাল বেঙ্গল আরও জানান, ২০১৮ সালে স্থানীয় জাতীয় পার্টির এক নেতাসহ স্থানীয়ভাবে বিষয়টি মিমাংসা করে দেবেন বলে সুগন্ধা হাউজিংয়ের মালিক আলম চাঁন কয়েকবার পদক্ষেপ নেন এবং ছেলে জাহাঙ্গীর আলমকে অনতিবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণসহ বিকল্প প্লট রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম প্লটের তৎকালীন মূল্যানুযায়ী ৮০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেবেন বলে জানান। কিন্তু জমির দাম আরও বেশি হওয়ায় মোস্তফা কামাল তা বাড়িয়ে দিতে অনুরোধ করেন। জাহাঙ্গীর ও তার পিতা আলম চাঁন পরে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন বলে জানান। তবে জাহাঙ্গীরের পিতা আলম চাঁন ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করলে জাহাঙ্গীর তার ও তার পিতার প্রতিশ্রুতির কথা বিবেচনা না করে ওই প্লটের কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্লটটি এককভাবে দখল করে নেন।
পরে ২০২৩ সালে মোস্তফা কামাল বেঙ্গল প্লটটি ফিরে পেতে হাউজিংয়ে আসলে তিনি দেখেন যে, তার কেনা প্লটের ওপর তার অনুমোদন ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন জাহাঙ্গীর।
এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে এবং প্লট ফিরিয়ে দিতে বললে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার বাপের কাছ থেকে আপনার জমি ক্রয় সঠিক ছিল না, তাই প্লট ফিরিয়ে দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না’।
এ ব্যপারে সুগন্ধা হাউজিংয়ের চেয়ারম্যান বেগম আলম চাঁন মোবাইল ফোনে এই প্রতিবেদককে জানান, মোস্তফা কামালের জমি কেনা সঠিক আছে। আমার স্বামী আলম চাঁন ওই প্লটটি তার কাছে বিক্রি করেছেন। তাই আমি এ বিষয় দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে তার সম্পদ তাকে ফিরিয়ে দেবো। তবে আমি ওমরাহ শেষে দেশে ফিরে ভীষন অসুস্থ, তাই একটু দেরি হচ্ছে।
তিনি এ সময় জোর দিয়ে বলেন, বিষয়টি সমাধান হতেই হবে। আমি ওমরাহ পালন করে দেশে এসে অসুস্থ হয়ে পড়েছি তাই একটু সময় লাগছে।
বেগম আলম চাঁন জানান, ইতোমধ্যেই তিনি তার ছেলে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।
এর আগে জাহাঙ্গীর আলমকে কয়েকবার মোবাইল ফোনে কল দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে তিনি তার ম্যানেজার সেলিম আখতারসহ কয়েকজনকে এ প্রতিবেদকের অফিসে পাঠিয়ে কয়েকবার সমাধানের আশ্বাস দিয়ে সময় নিয়েছেন।
এর আগে অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলম এই প্রতিবেদককে মোবাইল ফোনে বলেছেন, আমার ফ্যামিলির সবার সঙ্গে কথা না বলে এই প্লটের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারব না।
তার মতে, বাবার ক্রয়কৃত সম্পত্তির মালিকানা পারিবারিকভাবে বণ্টন করা হয়েছে।
তবে আলম চাঁনের অন্যন্য অংশীদাররা এই প্রতিবেদককে জানান, জাহাঙ্গীর একাই সেই প্লট দখল করেছে। তাই এর দায় আমরা নেবো না।
২০১৯ সালে সুগন্ধা হাউজিং প্রোপার্টি ডেভেলপমেন্ট এবং আলম নগরের স্বত্বাধিকারী মো. আলম চাঁনের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম সুগন্ধা হাউজিং প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এর পর থেকেই তিনি ভূমি ক্রয়-বিক্রয় ও দখল বাণিজ্য করে বহু কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেন।
সাভারের বামনি খালসহ বিভিন্ন মালিকানাধীন ও সরকারি খাস জমিতে অবৈধ দখল ও সরকারি খালের জমিতে বালি ভরাটের ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। একাধিকবার এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছে তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের পতিত নেতাদের সঙ্গে তার সখ্য থাকায় তিনি এসব দখলবাজি করতেন বলে জানান স্থানীয় সাইদ আহমেদ।
বর্তমানে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্পত্তিও তিনি দখলে নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যে বণ্টন করছেন বলে গুঞ্জন। জাহাঙ্গীর বর্তমানে ভোল পালটে বিএনপির ব্যানারে এই দখলবাজির কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ। দখলবাজি ও আশেপাশের জমির মালিকদের জমি আত্মসাতের জন্য তিনি এলাকাবাসীকে হয়রানিও করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। চিহ্নিত ভূমিদস্যু হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে সাভারজুড়ে। গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে জমি দখল ও জমির মালিক হয়রানীর অনেক অভিযোগ প্রকাশ হয়েছে।
এ ব্যাপারে সাভার মডেল থানায়ও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ রয়েছে। চান্দিুলিয়া ও বিলামালিয়া সরকারি খাস জমি দখলে নিয়ে ভরাট শুরু করলে তৎকালীন সহকারী কমিশনারের (ভূমি) পক্ষ থেকে সেখানে সাইনবোর্ড লাগালেও জমি ভরাটের কার্যক্রম এখনও বন্ধ হয়নি। সরকারি সব সাইনবোর্ড তার নির্দেশে উপড়ে ফেলা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, জাহাঙ্গীর আলম একজন ভূমিদস্যু এবং প্রতারক। সে বিভিন্ন সময় স্থানীয়দের জমি, সরকারি খাল ও খাস জমি দখল করায় তার বিরুদ্ধে এলাকাবাসী মানববন্ধনও করেছে। সরকারি বামন খাল দখল করায় সাভার সহকারী কমিশনার ভূমি অফিস থেকেও নোটিশ দিয়ে তাকে সতর্ক করা হয়েছে।
বিতর্কিত ভূমিদস্যু হিসেবে পরিচিত সুগন্ধা হাউজিং-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জিতু মোস্তাফা কামালের রেজিস্ট্রিকৃত দলিলের ১০ নম্বর প্লটে তার নিজস্ব ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান অট্টালিকা বিল্ডার্স লিমিটেডের মাধ্যমে ‘পিস পার্ক’ নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। যা বর্তমান আইনে অপরাধ।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানভীর আহমেদ খান যুগান্তরকে বলেন, এটা একটি ফৌজদারী অপরাধ। তার মাধ্যমে প্রতারণা, বিশ্বাসভঙ্গ ও অর্থ/জমি আত্মসাতের মতো গুরুতর অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে। এ বিষয়ে তার বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য ৪২০/৪০৬/৫০৬ ধারায় মামলা হতে পারে।