বিএমডিএর নতুন সেচ নীতিমালা: কমবে বোরোর উৎপাদন
আনু মোস্তফা, রাজশাহী
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:১১ পিএম
রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের বিশাল এলাকাজুড়ে বছরের পর বছর গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুলে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়ার ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর তলানিতে ঠেকেছে।
পানির স্তর এতটাই নিচে নেমেছে যে, এখন বরেন্দ্রভূমি রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার আট উপজেলার ২৬টি ইউনিয়ন এলাকায় ১৭০ ফুট খনন করেও পানি উঠছে না গভীর নলকূপে।
এসব এলাকার হাজার হাজার হস্তচালিত নলকূপ এক দশক আগেই অচল হয়েছে। অব্যাহত পানি সংকট মোকাবিলা ও ভূ-গর্ভের পানির স্তর রক্ষায় নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)।
সূত্রে জানা গেছে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। আসন্ন বোরো মৌসুমে পুরো সময়জুড়ে একটা গভীর নলকূপ ৯৮০ ঘণ্টার বেশি চালাবে না। বছরে একটা গভীর নলকূপ চলবে সর্বমোট ১ হাজার ৯৬০ ঘণ্টা।
কৃষকরা জানান, বিএমডিএর নতুন এ সিদ্ধান্তের কারণে বরেন্দ্রভূমির তিন জেলা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার পানি সংকট এলাকাগুলোতে বোরো চাষ অর্ধেকে নেমে আসবে। একটা গভীর নলকূপ এলাকার সেচ স্কিমের অর্ধেক জমিতে এবার বোরো চাষ করা যাবে। বাকি অর্ধেক জমিতে চাষ করতে হবে বোরো ছাড়া সেচ সুবিধাবিহীন প্রচলিত অন্য ফসল।
নতুন নীতিমালা সম্পর্কে আরও জানা গেছে, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযাযী এবার যে জমিতে বোরো চাষ করা হয়েছে আগামী বছর সেই জমিতে কম সেচনির্ভর অন্য ফসল চাষ করতে হবে।
এ নীতিমালা শুধু বোরো চাষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে বিএমডিএর সিদ্ধান্তে জানা গেছে। গত অক্টোবরে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ নতুন সেচ নীতিমালার এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও কৃষকেরা জানতে পেরেছেন ডিসেম্বরের প্রথমে প্রচারপত্র হাতে পেয়ে।
বরেন্দ্রের মাঠের কৃষকেরা জানিয়েছেন, গত ১ ডিসেম্বর নতুন সেচ নীতিমালার বিষয়ে অবহিত ও সচেতন করতে বিএমডিএর পক্ষ থেকে মাঠে মাঠে লিফলেট ও প্রচারপত্র বিতরণ শুরু করা হয়েছে।
প্রচারপত্র হাতে পেয়ে কৃষকদের মাঝে হতাশা নেমে এসেছে। মাঠে মাঠে এখন সেচ কর্তন জমি চিহ্নিত ও শনাক্তের কাজ করছে বিএমডিএর মাঠ কর্মকর্তারা।
বিএমডিএর প্রচারপত্রে বলা হয়েছে, নতুন সেচ নীতিমালা আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এ সময়ের বাইরে বোরোর নির্ধারিত জমিতেও আর সেচ দেওয়া হবে না।
সেচ সংকোচনে কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্তের বিষয়ে কৃষকদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল বলে কৃষক জানিয়েছেন। আর কদিন পরেই তারা বোরোর জমি তৈরির কাজ শুরু করবেন। এমন সময়ে বিএমডিএ এমন সিদ্ধান্ত জানিয়ে কৃষকদের হতাশ করেছেন।
বিএমডিএর নতুন সেচ নীতিমালার বিষয়ে কৃষকেরা বলছেন, নতুন নিয়মে সেচ দেওয়া হলে বরেন্দ্র অঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না। এর ফলে দেশের শস্যভান্ডারখ্যাত বরেন্দ্র এলাকায় আশঙ্কাজনকভাবে বোরো ধানের উৎপাদন কমে যাবে।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার কোয়েল গ্রামের কৃষক সলিম উদ্দিন সরদার বলেন, এলাকার হাজার হাজার হেক্টর আলুর জমিতে সেচ দেওয়া হচ্ছে। আমরা যারা টাকার অভাবে আলু করতে পারিনি ভেবেছিলাম সেই জমিতে বোরো আবাদ করব; কিন্তু নতুন সেচ নীতিমালায় জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বরং আলুর জমিতে সেচ না দিয়ে কৃষকদের বোরো আবাদের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল।
নতুন সেচ নীতিমালার বিষয়ে জানতে চাইলে বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, দেশি বিদেশি বিভিন্ন গবেষণা দেখা গেছে, বরেন্দ্রভূমির আট উপজেলা এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানিস্তর ক্রমাগতভাবে নিম্নগামী হয়েছে। এমনকি এলাকা মরুকরণ প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে। এসব গবেষণাকে আমলে নিয়ে বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ বোরো মৌসুমে অর্ধেক জমিকে বোরো চাষের আওতাবহির্ভূত ঘোষণা করেছেন। এর ফলে এলাকাগুলোর ভূগর্ভস্থ পানিস্তর রক্ষা পাবে পাশাপাশি মরুকরণ প্রক্রিয়া থেকে বাঁচবে লালমাটির উঁচু অঞ্চলটি।
জানা গেছে, গোটা উত্তরাঞ্চলের ১৩৫টি উপজেলা এখন বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত এলাকা। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় বিএমডিএর গভীর নলকূপের সংখ্যা ১৫ হাজার ৯৬৫টি। এর মধ্যে রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, গোমস্তাপুর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলা, নওগাঁর নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশায় রয়েছে ১ হাজার ৯৮০টি গভীর নলকূপ।
অন্যদিকে বিএমডিএর অধিভুক্ত এলাকায় ব্যক্তি মালিকানার প্রায় ৫৬ হাজার গভীর ও অগভীর নলকূপ ভূগর্ভের পানি উত্তোলন করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীতে ৭০ হাজার ২৬৫ হেক্টর, নওগাঁয় ১ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ৫১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে এবার বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিএমডিএর নতুন সেচ নীতিমালার কারণে এবার অর্ধেক জমিতে বোরো আবাদ করতে পারবেন কৃষকেরা। যেসব কৃষক বিএমডিএর সেচ স্কিমের বাইরে বোরো আবাদ করবেন তারা সেচ সুবিধা পাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, আমরাও বিষয়টি শুনেছি। আমরা বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য বিএমডিএকে বলেছি। নতুন সেচ নীতিমালার কারণে হাজার হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা থাকছে।