Logo
Logo
×

সারাদেশ

এখন আমিই বৈষম্যের শিকার: শহিদ জোবায়েরের স্ত্রী

Icon

ঈশ্বরগঞ্জ ও গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম

এখন আমিই বৈষম্যের শিকার: শহিদ জোবায়েরের স্ত্রী

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে উপজেলার কলতাপাড়ায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন জোবায়ের আহম্মেদ। সেদিন স্ত্রীর কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে তিনি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়েছিলেন। ২০ জুলাই স্বামীর মৃত্যুর পর স্বামীর গৃহও হারাতে হয়েছে স্ত্রী মোছা. মারজিনা আক্তারকে। 

সেদিন স্বামীর লাশ দেখে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার কাউরাট গ্রামের শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের স্ত্রী মারজিনা আক্তার। একপর্যায়ে তার হাত-পায়ের শক্তিও হারিয়ে ফেলেন। সুচিকিৎসার জন্য তাকে চলে যেতে হয় বাবার বাড়িতে। তিনি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার বড়হিত ইউনিয়নের বৃ-পাচাশী গ্রামের শহীদুল্লাহর মেয়ে।

মারজিনা আক্তার জানান, তিনি অসুস্থ হওয়ার পর স্বামীর বাড়ি থেকে তারা পাঠিয়ে দেয়। বাবার টাকায় সুস্থ হলাম। তারপর তারা (শ্বশুর-শাশুড়ি) কোনো খোঁজ নেয়নি। আমি যাওয়ার পরেও ভালো ব্যবহার করছে না। স্বামীর আত্মার শান্তির জন্য দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে, সেখানে যাওয়ার পর তারা খারাপ আচরণ করছে। বাড়িতে থাকতে দেয়নি। বের করে দিয়েছে। মা সঙ্গে গিয়েছিল তাকে বলেছে- মেয়ের সবকিছু নিয়ে বেরিয়ে যান। আর কোনোদিন আসবেন না। আমি কি কখনো আসতে বলেছি? 

তিনি বলেন, ৪ মাস চলে গেল; আমার তো সব অন্ধকার। স্বামী হারালাম, স্বামীর গৃহও হারালাম। বিয়ের পরে দেওয়া স্বর্ণালংকার ছিল, সবই নিয়ে গেছে। একটু সুখের আশায় সব বিক্রি করে স্বামী ব্যবসা শুরু করল। দোকানের মালামাল জিনিসপত্র, সহায়-সম্পদ সবই তাদের হয়ে গেল। আমি তো এখন শূন্য! স্বামীর সম্পদ বলতে, তার ঘ্রাণ নেওয়ার জন্য ‘বিয়ের পাঞ্জাবিটা, একটি টি-শার্ট আর একটি টাওয়াল’ নিয়ে এসেছি। 

মারজিনা আক্তার বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে আমার স্বামী শহিদ হলো, এখন তো আমিও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। শুনেছি সরকারি-বেসরকারি সংস্থা অনুদান দিচ্ছে; কেউ তো আমার খবর নিল না। কোনো সংস্থা এক টাকাও দেয়নি। আমার স্বামী হারিয়েছি, আমি তো সব হারিয়েছি, নি:স্ব হয়ে গেছি!

মারজিনার বাবা মো. শহীদুল্লাহ জানান, মেয়ের জামাই নেই; মেয়ে অসুস্থ। মেয়েকে সুস্থ করার জন্য একেকবার একেক ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েছি। সে তো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমার ২ ছেলে আর ৩ মেয়ের মধ্যে সে ৪র্থ। তাকে ভালো করার জন্য পরিবারের সবাই অস্থির হয়ে পড়ে। প্রায় ৪০ হাজার টাকা তখন ব্যয় হয়।

শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের শাশুড়ি মোছা. মনোয়ারা খাতুন বলেন, ৪০ দিনের মিলাদ অনুষ্ঠান ছিল। আমরা যাওয়ার পর তারা (মারজিনার শ্বশুরবাড়ির লোকজন) ভালো ব্যবহার করে নাই। মেয়েটার তারা খোঁজও নেয় না, নিয়ে যাওয়ার পর সেই বাড়িতে ঠাঁইও দেয়নি। তারা কখনো এ কথা বলে না যে জোবায়ের নেই; তুমি তো আছো, থাকো আমরা তো আছি। বরং কেন গেছে, কেন গেল; যা আছে সবকিছু নিয়ে বেড়িয়ে যান- এমন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে আমাদের বের করে দিয়েছে। 

শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের বাবা আনোয়ার উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি ছেলে হারিয়েছি। পুত্রবধূকে এখানে আমি কিভাবে রাখব, ওর তো নিরাপত্তার দরকার আছে। নিরাপত্তার কথা ভেবে ওর বাবার বাড়িতে যেতে বলেছি। আমি তার পরিবারকে বলেছি, সে তো স্বামীর মোহরানা পাবে। পরবর্তীতে বিয়েশাদী হলে তখন সহযোগিতা করা হবে। 

তিনি বলেন, পুত্রবধূ আমার ছেলের পাসপোর্ট চায়, ওর ভোটার আইডি কার্ড চায়, এগুলো নিয়ে সে কী করবে? এসব নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে। 

অভিযোগ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাকিল আহমেদ বলেন, জোবায়ের আহম্মেদের স্ত্রী এসেছিলেন। তিনি স্বামীর অংশ হিসেবে যা প্রাপ্য সেটুকু অবশ্যই পাবেন। দুই পরিবারকে নিয়ে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার উদ্যোগ নেব। 

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ২০ জুলাই গৌরীপুরের কলতাপাড়ায় ৩ জন শহিদ হন। তারা হলেন- ডৌহাখলা ইউনিয়নের চুড়ালী গ্রামের বাবুল মিয়ার ছেলে বিপ্লব হাসান, রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও মধ্যপাড়ার আব্দুল হালিম শেখের ছেলে নুরে আলম সিদ্দিকী রাকিব ও মইলাকান্দা ইউনিয়নের কাউরাট গ্রামের আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে জোবায়ের আহম্মেদ। 

কোটাবিরোধী প্রত্যেকটি আন্দোলনে অংশ নিয়ে নিজের দোকান বন্ধ করে ময়মনসিংহ চলে যেতেন জোবায়ের আহম্মেদ। 

মারজিনা আক্তার বলেন, আমার কাছ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে খেলতে যাচ্ছি বলে বেড়িয়ে পড়ে। বলল- চিন্তা করো না, চলে আসব। এলো লাশ হয়ে। কথাগুলো বলতে গিয়ে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। 

শহিদ জোবায়ের আহম্মেদের লাশ আন্দোলনকারীরা বাড়িতে ওই দিনই পৌঁছে দেয়। ছেলের জানাজায় ইমামতি করেন তার বাবা আনোয়ার উদ্দিন। জোবায়ের কাউরাট আকবর আলী দাখিল মাদ্রাসা থেকে ৮ম শ্রেণি পাশ করেন। এরপরে গৌরীপুর টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে ৯ম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এসএসসি পরীক্ষা দেন। কারিগরী কলেজে পড়া অবস্থাতেই পুরাতন মোবাইল কেনার ব্যবসা শুরু করেন। শম্ভুগঞ্জ এলাকায় দোকান ভাড়া নিয়ে তিনি পুরাতন মোবাইল কিনে তার যন্ত্রাংশ বিক্রি করতেন। একপর্যায়ে ব্যবসার পরিধি ব্যাপক হলে তিনি নিজে ভারত ও চীন থেকে মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানি এবং নতুন মোবাইল ফোন আমদানি করতেন। এছাড়া পুরাতন মোবাইলের যন্ত্রাংশও রপ্তানি করতেন তিনি। তার আয়ে পুরো সংসারটি ঘুরে দাঁড়ায়। 

জোবায়ের ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্বকাউরাট গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মোহাম্মদ আনোয়ার উদ্দিনের ছেলে। ৬ মেয়ে আর ৩ ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন ৮ম। জোবায়েরের বড় বোন উম্মে হানিফ শ্যামগঞ্জ ফাজিল মাদ্রাসার কামিল পরীক্ষার্থী। সবার ছোট ভাই কাউসার আহাম্মদ একই মাদ্রাসা থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম