রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস
অফিস শুরুর আগেই শুরু হয় ‘বিশেষ ফাইলের’ কাজ
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ পিএম
অফিস সময় শুরুর আগেই বিশেষ কিছু ফাইলে সই করে দেন রাজশাহী বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের উপপরিচালক রোজী খন্দকার। তারপর এসব ফাইলের পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ছবি তোলার কাজ শুরু হয়। সাধারণ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অভিযোগ আছে- দালালের মাধ্যমে যেসব ফাইল জমা হয় সেগুলোর কাজই শেষ হয় দ্রুত।
কয়েক মাস ধরে চলা এমন অনিয়মের প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে রাজশাহীর নাগরিক সমাজ।
বুধবার সকালে নগরীর শালবাগান বাজারে পাসপোর্ট অফিসের সামনে মানববন্ধন করে এ অনিয়ম দূর করার দাবি জানানো হয়েছে। পরে উপপরিচালক রোজী খন্দকারের সঙ্গে দেখা করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। এ সময় অনিয়ম দূর করতে এক মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে নাগরিক ভোগান্তি দূর না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
‘ভুক্তভোগী রাজশাহীর সাধারণ জনগণ’-এর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন- সামাজিক সংগঠন রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান, ক্যাবের রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলার সম্পাদক মাহমুদুল হক, নারীনেত্রী রোজিটি নাজনীন, সেলিনা বেগম প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, তারা লক্ষ্য করেছেন দালালের মাধ্যমে আসা বিশেষ ফাইলগুলো সরাসরি দোতলায় উপপরিচালক রোজী খন্দকারের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এসব ফাইলে সই করে দেন। তারপর দোতলাতেই সহকারী পরিচালক এসব ফাইল কম্পিউটারে এন্ট্রি করেন। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে ফাইলগুলো নিচতলায় চলে আসে। সেখানে ছবি তুলে দ্রুত সময়ের মধ্যেই পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা বাড়ি ফিরে যান। আর যারা দালালকে অতিরিক্ত টাকা না দিয়ে নিজেরাই এসে লাইনে দাঁড়ান, তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিচতলায় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়। এর ফলে অসংখ্য মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
তারা বলেন, দালাল না ধরে ফাইল আনলে শুধু ভুলই খোঁজেন কর্মকর্তারা। আর দালালের মাধ্যমে ফাইল এলে কিছুই দেখা হয় না। দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিসের প্রত্যেক কর্মকর্তা প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা কামাই করছেন। আর নিচতলায় একজন ব্যক্তি সাধারণ মানুষের পাসপোর্টের ফাইল এন্ট্রি করেন। মাঝে-মধ্যেই তিনি আবার ডেস্ক ছেড়ে উঠে যান। ফলে সাধারণ মানুষের লাইন আর এগোয় না। এসব অনিয়ম অচিরেই বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পাসপোর্ট অফিসের জনবল ও ছবি তোলার কক্ষ বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হয়।
মানববন্ধন শেষে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এসব বিষয় নিয়ে উপপরিচালক রোজী খন্দকারের সঙ্গে কথা বলতে তার কক্ষে যান। এ সময় রোজী খন্দকার সব অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দুর্নীতির প্রমাণ দেখাতে বলেন।
এ সময় রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান তাকে হুঁশিয়ার করে বলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে সব অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করে নাগরিক ভোগান্তি দূর করা না হলে বৃহত্তর কর্মসূচি দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, উপপরিচালক রোজী খন্দকার পাসপোর্টের ‘জি-২৫’ সিন্ডিকেটের সদস্য হিসেবে পরিচিত। বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো পাসপোর্ট অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) আবু আসাদ যখন পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) ছিলেন তখন তার ছত্রছায়ায় তৎকালীন পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম ‘জি-২৫’ সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন বলে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে আসে।
এই সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। তারা প্রতিদিন অন্তত ২৫ লাখ টাকা ঘুস আদায় করেন বলে তারা জি-২৫ সিন্ডিকেটের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পান। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০২১ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই সিন্ডিকেটের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। ওই সময় কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করে দুদক।
এই সিন্ডিকেটটির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা ও ভারতীয়দের নামে পাসপোর্ট ইস্যু, একই ব্যক্তির বিভিন্ন নামে একাধিক পাসপোর্ট ইস্যু, দালাল-সিন্ডিকেট প্রতিপালন, পদোন্নতি প্রদান, প্রাইজ পোস্টিং দেওয়াসহ নানা অনিয়মে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। রাজশাহীর এখনকার উপপরিচালক রোজী খন্দকার ই-পাসপোর্ট এবং স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন প্রকল্পে কর্মরত থাকাকালে এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি যেখানেই গিয়েছেন সেখানেই মানুষকে জিম্মি করে অবৈধ উপার্জনের অভিযোগ ওঠে।
রাজশাহীতে আসার আগে তিনি ছিলেন জয়পুরহাট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে। তিনি সেখানে থাকার সময়ও দালালদের প্রতিপালন করতেন। দালাল না ধরলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির শেষ ছিল না। কয়েক মাস আগে তিনি রাজশাহীতে যোগ দেওয়ার পর একই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপপরিচালক রোজী খন্দকার বলেন, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অনুমতি ছাড়া তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।