Logo
Logo
×

সারাদেশ

পূর্বাচলের ৩০০ ফুট যেন লাশের ডাম্পিং পয়েন্ট

Icon

এ হাই মিলন, রূপগঞ্জ থেকে

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ পিএম

পূর্বাচলের ৩০০ ফুট যেন লাশের ডাম্পিং পয়েন্ট

ঢাকার উপকণ্ঠে পূর্বাচলে ঘটে চলেছে একের পর এক অপরাধের ঘটনা। বিশাল এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেই তৎপরতা নেই; তাদের তদারকি মধ্যে দেখা যায় দায়সারা ভাব। এইসব কারণে খুন, ডাকাতি ছিনতাই, ধর্ষণ, মারামারিসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা ঘটেই চলছে দিনের পর দিন।  গত আট বছরে এ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা স্বীকার হওয়ার মধ্যে ২১টির ও বেশি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। 

২০১৭ সালে ২ জুন পূর্বাচলে অস্ত্র গোলাবারুদ ও মারাত্মক ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছিল। তখনকার বিশেষজ্ঞদের মতে যুদ্ধে ব্যবহার উপযোগী ছিল অস্ত্রগুলি।  বড় কোনো উদ্দেশ্যে কোনো জনগোষ্ঠী এসব অস্ত্র সংগ্রহ করেছিল। এই বিধ্বংসকারী মারাত্মক ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র রকেট লাঞ্চারসহ অনেক গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছিল। এ ধরনের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। আজ পর্যন্ত পুলিশ এর রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।

নির্জন ও সেফ জোন হওয়ায় বাইরে হত্যার পর নির্বিঘ্নে লাশ ফেলে রেখে যায় এসব স্থানে।  বিশ্বের অন্যতম আধুনিক শহর পূর্বাচল উপশহর। রাজউকের অধীনে গড়ে উঠা পূর্বাচলের সিংহভাগ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গড়ে উঠলেও গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলা থেকেও কিছু অংশ পূর্বাচলে নেওয়া হয়েছে। পূর্বাচলের দৃষ্টিনন্দন ৩০০ ফুট সড়ক যে কারো মন কাড়তে বাধ্য। তাই তো শহরের ব্যস্ততা থেকে একটুখানি অবসরের আশায় ভ্রমণ পিপাসুরা বেড়াতে আসেন পূর্বাচলে। পূর্বাচল উপশহর ঢাকাসহ আশপাশের বাসিন্দাদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। পূর্বাচলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে লোভনীয় সব ফাস্টফুড, হাঁসের মাংস, চিতই পিঠা, চাপটি, খেলনার দোকান, মিষ্টির দোকান, নানা ধরনের পিঠা ও নানা ধরনের কাঁচা শাক সবজির দোকানসহ হরেক রকমের কয়েক হাজার দোকানপাট। 

দিনের আলো ও সন্ধ্যার দিকে পূর্বাচল পর্যটকে মুখরিত থাকলে ও সূর্যাস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে নেমে আসে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও সুং সাং নীরবতা। রাত যতোই গভীর হতে থাকে ততোই বাড়তে থাকে নিরবতা। রীতিমতো গা ছমছমে পরিবেশ। ৩০০ ফুট সড়কে সড়ক বাতি থাকলেও পূর্বাচলের ভেতরে শাখা রাস্তাগুলোতে কোনো সড়ক বাতির ব্যবস্থা নেই। এ কারণে ভেতরে রাস্তাগুলো থাকে নিরব ও সুনশান। নিরব ও সুনশান জায়গায়ই অপরাধীদের অপরাধ করার জন্য উত্তম স্থান। তাই পূর্বাচল উপ-শহরে ঘটে চলছে একের পর এক অপরাধ যজ্ঞ। পূর্বাচলের বিশাল এরিয়াতে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত তৎপরতা না থাকায় হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে দিনদিন। গত ৮ বছরে পূর্বাচল থেকে ২১টি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে পূর্বাচল উপশহর লাশের ডাম্পিং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। হত্যার পর লাশ ফেলা হয় পূর্বাচলের নির্জন স্থানে। 

আট বছরে পূর্বাচলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২১টি মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৩ নভেম্বর সকালে জসিম উদ্দিন নামে নারায়ণগঞ্জের এক শিল্পপতির লাশ পূর্বাচলের ৫নং সেক্টরের একটি লেক থেকে ৭ টুকরো করা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন বিকালে ১৭ নম্বর সেক্টর থেকে জসিম উদ্দিনের লাশের আরও ৩টি টুকরো উদ্ধার করা হয়। পরকীয়ার জের ধরে শিল্পপতি জসিম উদ্দিনকে হত্যা করা হয় ঢাকার কোন এক স্থানে।  তারপর সেভজোন হিসেবে ফেলে রেখে যায় রূপগঞ্জের পূর্বাচলে। এ ঘটনায় রুমা আক্তার নামে এক নারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। একই বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর পূর্বাচলের ১০ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সেতুর নিচ থেকে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় মানুষের একটি কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। ২০১৭ সালের ২৪ এপ্রিল ১৩ নম্বর সেক্টরে ব্রিফকেসের ভেতর থেকে তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ১১ নম্বর সেতুর নিচ থেকে গুলিবিদ্ধ সোহাগ, শিমুল ও আজাদ নামে তিন যুবকের মরদেহ, একই বছরের ৭ নভেম্বর ১০ নম্বর সেক্টর থেকে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৯ সালে ভোলানাথপুরের কাশফুলের ঝোপ থেকে এক ধর্ষিতার তরুণীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই বছরের ১৬ নভেম্বর নিখোঁজের চারদিন পর মাওলা (১৬) নামে অটোচালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি ৮ নম্বর সেক্টর থেকে মজুর উদ্দিনের মরদেহ, ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি ১০ নম্বর সেক্টর থেকে মিলন মিয়ার মরদেহ, একই বছরের ২৩ আগস্ট ৪ নম্বর সেক্টর থেকে সাত মাসের নবজাতকের মরদেহ, একই বছরের ৮ অক্টোবর ৭ নম্বর সেক্টর থেকে হৃদয় হাসানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২১ সালের ১৬ অক্টোবর পূর্বাচলের ২৬ নম্বর সেক্টর থেকে সাইফুল ইসলাম (২৬) নামে এক ইজিবাইক চালকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। একই বছর অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তির লাশ ৪ নম্বর সেক্টর থেকে  উদ্ধার করে।  ২০২২ সালের ১৯ মে ২৫ নম্বর সেক্টর থেকে মজিবুর রহমানের মরদেহ, একই বছরের ২৭ ডিসেম্বর অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।  গত বছরের ৭ জুলাই ১৯ নম্বর সেক্টর থেকে অজ্ঞাতনামা যুবকের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। একই বছরের ২৪ আগস্ট ২০ নম্বর সেক্টর এলাকার একটি সবজিখেত থেকে আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের লাশ উদ্ধার করা হয়। 

আরও অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকার রাজউকের অধীনে পূর্বাচলের জমি অধিগ্রহণ করার পর স্থানীয়দের অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বাড়িঘর নির্মাণ করেন। ফলে ফাঁকা হয়ে পড়ে পূর্বাচল। এ ছাড়া একেকটি এলাকা যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত। কুড়িল বিশ্বরোড-কাঞ্চন ৩০০ ফুট রাস্তা হওয়ার পর থেকে পূর্বাচল যেমন পর্যটকদের জন্য জনপ্রিয় পর্যটর কেন্দ্র হয়ে উঠে তেমনি অপরাধীদের জন্য হয়ে উঠে অপরাধের স্বর্গরাজ্য। পূর্বাচলের প্রত্যেকটি এলাকাই দুর্গম এক জনপথ। ফলে অপরাধীরা নির্বিঘ্নেই তাদের কার্যক্রম চালাতে এলাকাকে বেছে নিয়েছে। তবে, দিনের আলোতে পূর্বাচল উপ-শহর যত সুন্দর রাতের বেলাতে ঠিক ততটাই ভয়ংকর। এ যেন এক ভয়ংকর সুন্দর। রাত হতে না হতে এখানে বেড়ে যায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম। রাত যত বাড়তে থাকে পূর্বাচলে অপরাধীদের আনাগোনাও বেড়ে যায়। ঢাকা থেকে পূর্বচল উপ-শহরের দুরত্ব কম হওয়ায় অনেকেই এখানে পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব, প্রেমিক-প্রেমিকা ঘুরার সময় অনেকে ছিনতাই ও ডাকাত দলের কবলে পড়ে সব হারাতে হয়েছে। এখানে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মতো বড় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটছে। 

কথা হয় ভোলাবো এলাকার শরিফ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাইত বারার সাথে সাথে এখানে বিভিন্ন লোকেদের  ঘোরাফেরা দেখা যায়, ভাই রাইতে বেলা পূর্বাচলের ভেতরের রাস্তাগুলো এতোডাই অন্ধকার থাকে কিছু দেহা যায় না। তাই এই কারণে এইখানে বেশিরভাগ সময় ছিনতাই ও ডাকাতি হয়ে থাকে।’

কাঁচামালের ব্যবসায়ী মোতালিব মিয়ার তিনি যুগান্তরের সাংবাদিককে বলেন, ‘বাবাগো রাজউকে আমাগো জমি লইয়া যাওনে পর থেইকা পূর্বাচল আন্ধারই থাকে। শিয়াল কুত্তায় শুধু ডাকাডাকি করে। কয় দিন পর পর দেহি লাশ পাওয়া যায় পূর্বাচল থেইকা। পুলিশ ঠিকমতো পূর্বাচলের নির্জন এলাকাগুলা দিয়া ঘুরলে আর এইসব অপরাধ অইতো না।’

ভাগবের এলাকার নাসির মিয়া বলেন, পূর্বাচলে প্রায় সময় অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা দেখা যায়। জিজ্ঞেস করলেই লোকজন প্লট দেখার কথা বলে। কিন্তু তাদের চালচলনে মনে হয় না প্লট দেখার বিষয়টি সত্য। এলাকাবাসী ট্রিপল ৯৯৯ ফোন দিলে পুলিশ ও আসে না রুপগঞ্জ থানাকে জানালে দেখি দেখতেছি বলে জানায়। 

পূর্বাচলে ছিনতাইয়ে সক্রিয় ৮ সিন্ডিকেট কয়েক সপ্তাহ আগে রাজধানী ঢাকার উত্তরা থেকে পূর্বাচল উপশহরের স্বামীকে নিয়ে ঘুরতে এসেছিলেন উর্মী আক্তার নামে এক গৃহকর্মী। পূর্বাচল থেকে যেতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। পূর্বাচল থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে একদল ছিনতাইকারী তাদের কাছ থেকে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। শুধু উর্মী আক্তার নয় পূর্বাচলে বেড়াতে এসে প্রতিনিয়ত ছিনতাইয়ে শিকার হচ্ছে ঘুরতে আসা দর্শনার্থীরা।  চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর সাজ্জাদ নামে এক যুবককে গাড়ি করে এয়াপোর্ট থেকে উঠিয়ে পূর্বাচলে নিয়ে আসে। পরে তার কাছ থেকে ৭ ভরি স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা ছিনতাই করে নিয়ে যায় একটি চক্র। পূর্বাচলে ছিনতাইয়ে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ৮টি সিন্ডিকেট। এ ৮টি সিন্ডিকেটে মো. সাইফুল ইসলাম মো. মাহাবুর রহমান, মো. ওবায়দুর রহমান, রমজান আলী, ডাকাত সর্দার বাবুসহ অন্তত ৪৫ জন সদস্য রয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের কাজ পূর্বাচলে ছিনতাই ডাকাতি ও হত্যাসহ নানা অপরাধ ঘটানো। ২০১৯ সালের ১০ মে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট রোডের ছমু মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে মো. সাইফুল ইসলাম, মো. মাহাবুর রহমান, মো. ওবায়দুর রহমান, এবং মো. বেলায়েত হোসেনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এছাড়া ২০১৭ সালে ৩ জুন পূর্বাচল উপ-শহরের ৫নং সেক্টরের একটি খাল থেকে ৬১টি চায়না মেশিনগান, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু বোরের ৫টি পিস্তল, ২টি রকেট লঞ্চার, ৪২টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ৪৯টি মর্টারশেল, দুটি ওয়ারলেস সেট, ১৫২৭ রাউন্ড গুলি, ৪৪ টি ম্যাগাজিন ও ৪৯টি রকেট লঞ্চার প্রজেক্টর। বিপুল পরিমান অস্ত্র উদ্ধারের সাত বছর পেরিয়ে গেলে এতো অস্ত্রেও রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

এ ব্যাপারে ’গ’ সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মেহেদী ইসলাম বলেন, আমাদের পূর্বাচলের পুলিশ ক্যাম্পটি কার্যক্রম চলেনি। সম্প্রতি ক্যাম্পটি চালু করেছি। আমাদের পুলিশের জনবল সংকট রয়েছে। তবুও আমরা পূর্বাচলে টহল বাড়ানো চেষ্টা চালাচ্ছি। পূর্বাচল লাশের ডাম্পিং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, সম্প্রতি পূর্বাচলে জসিম উদ্দিন নামে এক শিল্পপতির ৭ টুকরো করা লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই উদঘাটন করতে পেরেছি। আমরা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা- শুধু কথায় না কাজ করে দেখাতে চাই। এদিকে ওসিকে না পেয়ে যুগান্তরের সাথে কথা হয় ইনভেস্টিগেশন ইন্টেলিজেন্ট অফিসার মো. সালাউদ্দিন কাদেরের সঙ্গে।  তিনি বলেন, দ্রুতই আমরা সাত খণ্ড লাশের তদন্ত বিষয়টি নিয়ে বের করতে বের করেছি।  একজন গ্রেফতারও করেছি। পূর্বাচলের ডাকাতি ও ছিনতাই এর ঘটনা ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয় তিনি বলেন, তবে আমাদের জনবল সংকট থাকায় আমাদের তদন্তে কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম