এক ভূমি অফিসে ৩ নায়েব, স্বাক্ষর দিতে নেন ১০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা
এ হাই মিলন, রূপগঞ্জ
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২২ পিএম
এক ভূমি অফিসে তিন নায়েবের তিন চেয়ার! একজন বড়, দুজন ছোট নায়েব। তাদের আছে প্রভাবশালী চার উমেদার। রাহেল, হারুন, লিটন, আলী। নায়েবদের সঙ্গে দেখা করতে টিকিট নিতে হয় উমেদারদের কাছ থেকে। যেখানে ৮ হাজার থেকে শুরু করে ১০ হাজার; আবার জমির পরিমাণভেদে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত নামজারির অলিখিত ‘খরচ’ দিতে বাধ্য হচ্ছেন জমি মালিকরা। অনেকে খরচের নামে ঘুস দিয়ে প্রতারণার শিকারও হচ্ছেন। এমন চিত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের তারাবো পৌর ভূমি অফিসের।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, তারাবো পৌর ভূমি অফিসে ঘুস ছাড়া মেলে না নামজারি, চেক দাখিলাসহ কোনো প্রকার ভূমিসেবা। এখানে অনলাইনে আবেদন করলেও জমি মালিকরা বাধ্য হয়ে নায়েবদের স্বাক্ষর পেতে গণনা করেন ১০ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকা। আর টাকা দিলে তদন্ত ছাড়াই মূল কাগজ না দেখে স্বল্প সময়ে স্বাক্ষর করেন সহকারী নায়েব রোকেয়া আক্তার। কোনো কোনো সময় নায়েবরা সরাসরি টাকা না নিলেও উমেদার রাহেল, হারুন, আলী ও লিটনের মাধ্যমে গ্রহণ করেন ঘুসের টাকা।
রূপগঞ্জ উপজেলার ভূমি অফিসের সব কয়টি ইউনিয়ন ও পৌর ভূমি অফিসে চলছে ঘুসের রাজত্ব। গত ৪ নভেম্বর দুপুরে তারাবো পৌর ভূমি অফিসে এই প্রতিবেদকের সামনেই ২ লাখ টাকা নিয়েও জমা-খারিজ না পাওয়ার অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা সুবর্ণা আক্তার। তার দাবি, পৈতৃক সম্পদ প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঘুস পেয়ে নামজারি আটকে দেন নায়েব। তিনি বলেন, আমার প্রতিপক্ষ সমির মুন্সি তারাবো পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর আনোয়ারের হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা দেখিয়ে আমার পৈতৃক ওয়ারিশ হিসাবে পাওয়া জমির জমা-খারিজ করতে দেয়নি। ৫ আগস্টের পর খারিজ করতে এলে নায়েব সরাসরি ২ লাখ টাকা ঘুস দাবি করেন। আমি বাধ্য হয়ে ২ লাখ টাকা দিই। কিন্তু কিছুদিন পর আমাকে না জানিয়ে প্রতিপক্ষের লোকজনের কাছ থেকে নগদ ৫ লাখ ঘুস নিয়ে আমাকে নোটিশ না করেই জমাখারিজ কেটে ফেলেন। এতে আমার জমির মালিকানা নিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছি। তেতলাবো এলাকার মনিরুল কবির বলেন, আমার ১০২ শতক জমি খাজনা-খারিজ করতে এলে ২ লাখ টাকা দাবি করেন। তা দিতে দেরি করায় ফাইল গায়েব করে দেন নায়েব। এ সময় সহকারী নায়েব রোকেয়ার নাম বলে তার সহকারী রাহেল মিয়া আবার আমার কাছ থেকে ৫০ হাজার নেন। কিন্তু ওই সময় ভিডিও ধারণ করছি তা বুঝতে পেরে আমাকে দালাল সাজিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে হয়রানি করে। এ ঘটনায় আমি আতঙ্কিত।
উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা বরপা এলাকার বাসিন্দা উদ্যোক্তা বকুল বেগম বলেন, আমার ১৪ শতক জমির মাঝে সাড়ে ১২ শতক জমি খারিজ করার সময় নায়েবকে ৫০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। পরে বাকি জমির খারিজ করতে এলে আপিলের নাম করে ১০ লাখ টাকা দাবি করে উপজেলা ভূমি অফিসের লোক। একই চিত্র নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের ৭টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভার ভূমি অফিসগুলোতে। ভয়াবহ চিত্র রূপগঞ্জ সদর ও কায়েতপাড়ায়। সেখানে নির্ধারিত সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়াও উমেদার ও দালালের সংখ্যা বেশি।
এদিকে প্রেষণের নামে নারায়ণগঞ্জের অন্য একটি অঞ্চলের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা রোকেয়া আক্তার গত এক বছর ধরে অফিস করছেন তারাবো পৌর ভূমি অফিসে। কিন্তু বেতন নিচ্ছেন পূর্বের কার্যালয় থেকে। যদিও এখানে ২ বছর ধরে আরেকজন সহকারী নায়েব বিপুল চন্দ্র একই পদে বহাল রয়েছেন। উমেদারদের মাধ্যমে ঘুস নেন তারা। বড় নায়েব অনেক সময় নিজেই গ্রহণ করেন ঘুসের টাকা। যদিও এসব অভিযোগ আংশিক অস্বীকার করেছেন তারা।
সহকারী নায়েব রোকেয়া আক্তার বলেন, আমাকে ডিসির নির্দেশে এখানে ১ বছর ধরে রাখা হয়েছে। আমি বা আমার কোনো লোক কোনো অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত নই। তারাবো পৌর ভূমি অফিসের নায়েব আব্দুল কাদির বলেন, আমি সরাসরি কিছুই নিইনি। যিনি অভিযোগ করেছেন তিনি হয়তো দালালের মাধ্যমে লেনদেন করেছেন। জানতে চাইলে রূপগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি (দক্ষিণ) তারিকুল আলম বলেন, ভূমি অফিসে দালাল প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘুস লেনদেনের প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থার আশ্বাস দেন তিনি।