সংসারের অভাব মেটাতে বাড়ি ছেড়ে নারায়ণগঞ্জের তারাব এলাকায় একটি সোয়েটার কোম্পানিতে কাজ নেন আবদুল্লাহ আল মামুন (৪২)। এরপর সাত বছর ধরে সেখানেই পরিবার নিয়ে থাকতেন তিনি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। আয়-রোজগার না থাকায় ক্ষোভ বাড়ছিল তার। এ সময় আন্দোলনে যোগ দেন তিনি, কিন্তু পিঠ ও হাতে তিনটি গুলি লেগে জীবনপ্রদীপ নিভে যায় তার। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৬ আগস্ট মারা যান তিনি।

তবে সন্তানরা জানে না তাদের বাবা মারা গেছেন। তাদের সন্তান শেখ সাদী বলে- ‘আব্বার পিঠে গুলি লাগছে, আর কদিন পর বাড়িত আইব’।

এদিকে মামুনকে হারিয়ে চার মাসের এক শিশুসহ তিন সন্তান নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটছে স্ত্রী ছাবিনা আক্তারের (৩৫)। স্বামীর ঘরবাড়ি না থাকায় সন্তানদের নিয়ে এখন কোথায় যাবেন তিনি! সেই ভাবনা তাড়া করে বেড়াচ্ছে ছাবিনাকে।

নিহত আবদুল্লাহ আল মামুনের বাড়ি নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা সদরের বটতলা গ্রামে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবার সূত্রে জানা যায়, মামুন গ্রামের মাদ্রাসায় কিছুদিন লেখাপড়া করে সিলেটের জকিগঞ্জ একটি মাদ্রাসায় যান। জেলার কলমাকান্দার গুতুরা দাখিল মাদ্রাসা থেকে অষ্টম শ্রেণি পাসের পর অভাবের কারণে আর লেখাপড়া চালানো সম্ভব হয়নি। এরপর বাবার সঙ্গে কৃষিকাজে যোগ দেন তিনি। পরে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। ২০০৮ সালে মামুন ও ছাবিনার বিয়ে হয়। তাদের তিন সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে সাদিয়া আক্তার (১২) বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, মেজ ছেলে শেখ সাদি (৬) একটি মক্তবে লেখাপড়া করে এবং অপর ছেলে শেখ ফরিদের বয়স চার মাস।

মামুন ৫ আগস্ট দুপুরে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। ডান হাত ও পিঠে তিনটি গুলি লেগে অচেতন হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন তিনি। পরে সঙ্গে থাকা লোকজন তাকে উদ্ধার করে কাছের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখান থেকে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি গুলি বের করা হয়। পরের দিন দুপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ওই দিন রাতে স্বজনেরা তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। পরের দিন সকালে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

ছাবিনা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, তাদের সহায়-সম্বল বলতে কিছুই নেই। এমনকি বাড়িতে থাকার একটি ঘরও নেই। ছাবিনা এখন আল মামুনের বড় ভাই মো. অলি উল্লাহর ঘরের একটি কক্ষে আশ্রয় নিয়েছেন। চার মাস আগে আবদুল্লাহ আল মামুনের বাবা আবদুল ওয়াহেদ মারা যাওয়ার আগে বাড়ির জায়গা সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেন। সেখানে মামুন ঘর উঠাতে ৪ শতাংশ জায়গা পেয়েছিলেন। টাকা জমিয়ে ওই জায়গায় বছরখানেকের মধ্যে ঘর উঠানোর স্বপ্ন ছিল মামুনের, কিন্তু তার সব স্বপ্ন শেষ।

আল মামুনের ছেলে শেখ সাদি বাবার ব্যবহৃত স্মার্টফোনটি হাতে নিয়ে বারবার বাবার ছবি দেখে। ছেলের বিশ্বাস, তার বাবা হাসপাতালে আছেন। কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে ফিরবেন। মাকে সে জিজ্ঞেস করে, কবে আসবে বাবা? শেখ সাদি তার মাকে বলে, ‘আমার আব্বার পিঠে গুলি লাগছে, আর কদিন পর আব্বা বাড়িত আইব।’

মামুনের স্ত্রী ছাবিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামী কী দোষ করেছিল? এমন নির্মমভাবে তারে গুলি কইরা মারতে হইছে! অহন এতিম শিশু সন্তানদের লইয়া আমি কার কাছে, কই যাইবাম? থাহনের ঘরটা পর্যন্ত নাই। এতদিন অইল, কেউ খোঁজ নেয় না। কেউ আমার এতিম বাচ্চাদের সাহায্য করেনাই। আমার সন্তানদের একটা থাকার ঘরও নাই। কী অইবো আমার সন্তানদের ?’

আল মামুনের মা জহুরা বলেন, ‘আমার পুত কাউরে মনে কষ্ট দিয়া কথা কইছে না। যারা আমার কোল খালি করছে, তার তিনডা বাচ্চারে এতিম করছে, আল্লাহর কাছে এই বিচারভার দিলাম।’

মামুনের বড় ভাই মো. অলি উল্লাহ বলেন, ‘আমার ভাই মারা যাওনে তার স্ত্রী সন্তানদের নিয়া খুবই কষ্টে আছে। আমার আর্থিক অবস্থাও সচ্ছল না। তা–ও আমার ঘরে তাদের ঠাঁই দিছি। যেমন পারতাছি, সহযোগিতা করছি। কিছু টাকাপয়সা সাহায্য পাইলে তার জায়গাডাতে একটা ঘর বানানো যাইত।’

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির আইনবিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘আবদুল্লাহ আল মামুনের পরিবারটি খুবই দরিদ্র। মামুনের স্ত্রী-সন্তানদের জন্য একটি ঘর তৈরি করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পরিবারটি যাতে স্বাভাবিকভাবে জীবন ধারণ করতে পারে, সে ব্যবস্থা করা হবে।’