মামলার সাক্ষী নূর নবীকে হত্যার অভিযোগ, জড়িতদের বাঁচানোর চেষ্টা
মো. নাজমুল হুদা নাসিম, বগুড়া ব্যুরো
প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ পিএম
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, জনপ্রতিনিধি কেউ বিশ্বাস করেন না রাজমিস্ত্রি নূর নবী প্রামাণিক (২৪) আত্মহত্যা করেছেন। দুটি অপহরণ মামলায় সাক্ষী হওয়ায় আসামি ও তাদের লোকজন তাকে ডেকে নিয়ে হত্যার পর বাঁশের সঙ্গে গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বলে সবাই ধারণা করছেন।
আর আসামিদের বাঁচাতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তদবির করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোমবার দিনভর উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের রামনগর মণ্ডলবাড়ি ও চর রামনগর গ্রামে ঘুরে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
চর রামনগর গ্রামের ৯০ বছরের বৃদ্ধ শুকুর আলী আকন্দ জানান, মৃত কান্টু প্রামাণিকের ছেলে তার প্রতিবেশী নাতি নূর নবী খুব ভালো ছেলে ছিল। কারো সঙ্গে বা সাংসারিক কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তাই সে আত্মহত্যা করতে পারে না; কেউ তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে।
নিহত নূর নবীর স্ত্রী রোজিনা বেগম জানান, স্বামীর সঙ্গে তার কোন মনোমালিন্য নেই। তার কোনো ধরনের ঋণ বা ধারদেনা নেই। ঘটনার দিন ঝগড়াও হয়নি। আত্মহত্যা করলে বাড়ি বা আশপাশে করতে পারতো। আধা কিলোমিটার দূরে মণ্ডল বাড়িতে যাওয়ার কারণ নেই। নূর নবী পার্শ্ববর্তী বিএনপি কর্মী আরিফুজ্জামান কোয়েল মণ্ডল ও তার চাচা নুন্নু মণ্ডলের বাড়িতে গাছ থেকে ফল পাড়াসহ সাংসারিক কাজ করে দিতেন। বিনিময়ে কোয়েলের মা হেনা বেগম তাকে (নূর নবী) পাঁচ শতক ডোবা (পুকুর) দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত তিনি সে কথা রাখেননি। পরবর্তীতে পুকুরটি সেকেন্দার কসাইয়ের কাছে বিক্রি করেন।
নূর নবীর স্ত্রী রোজিনা বেগম আরও জানান, গত ১৮ অক্টোবর সকাল ৮টার দিকে তার স্বামী দুই মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ের জন্য খাবার আনার কথা বলে কোয়েল মণ্ডলদের বাড়িতে যান। এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর সৌরভ মণ্ডলদের কাজের মেয়ে বেবীর মাধ্যমে খবর পান সৌরভ মণ্ডলের বাঁশঝাড়ে তার স্বামী নূর নবীর লাশ ঝুলে আছে।
তিনি বলেন, তার স্বামীর আত্মহত্যার কোনো কারণ নেই। তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যাকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দিতে নাটক সাজানো হয়েছে। আর তারা গত ২৫ দিনে একবারও খোঁজ নিতে আসেনি। এতে তার সন্দেহ তারাই নুর নবীকে হত্যা করেছে। এরপর থেকে সৌরভরা গা-ঢাকা দেন।
নূর নবীর ভাই ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন একই মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, তার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। ভাইয়ের থুতনিতে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ব্যাপারে তিনি শিগগিরই কোয়েল মণ্ডল, সৌরভ মণ্ডল ও জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা মামলা করবেন।
সারিয়াকান্দি উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের মেম্বার শহিদুল ইসলাম জানান, তার বিশ্বাস রাজমিস্ত্রি নূর নবী আত্মহত্যা করেননি। তাকে কেউ ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ বাঁশের সঙ্গে গামছা দিয়ে ঝুলিয়ে দেয়।
রামনগর মণ্ডলবাড়ি গ্রামের মুন্নু মণ্ডলের ছেলে আরিফুজ্জামান কোয়েল মণ্ডল ও তার মা হেনা বেগম জানান, নাহিদ জামান সৌরভ মণ্ডল তাদের আত্মীয়। নূর নবী ছোটবেলা থেকে তাদের বাড়িতে কাজ করে আসছে। তারা দাবি করেন, নুর নবী ঋণগ্রস্ত ছিল। সে অভাবের কারণে মোবাইল ফোন বিক্রি করতে চেয়েছিল। অভাব ও ঋণের কারণে হয়তো সে আত্মহত্যা করেছে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে মামলার আসামি বিএনপি কর্মী নাহিদ জামান সৌরভ মণ্ডল বলেন, গত ২৯ আগস্ট বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ষষ্ঠ তলায় দরজার সামনে আনোয়ার রহমানের স্ত্রীর সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। এতে তার হাত ভেঙে যায়। এ ব্যাপারে আনোয়ারদের বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করি। এরপর থেকে তিনি এলাকার বাহিরে। তার বাঁশঝাড়ে নূর নবীর ঝুলন্ত লাশ পাওয়া গেলেও এর সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এটা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ।
সারিয়াকান্দি উপজেলার নামনগর গ্রামের মৃত ডা. একেএম আক্কাস আলীর ছেলে আনোয়ার রহমান বলেন, তিনি গত ২৯ আগস্ট সারিয়াকান্দি থানায় রামনগর মণ্ডলবাড়ির মৃত মাইনুল ইসলাম বাঘার ছেলে নাহিদ জামান সৌরভ ও মেয়ে মনিরা খানম বিথি, মোসাদ্দিকা নাজনীন সাথী এবং সাবেক যুবলীগ কর্মী লাড্ডু মণ্ডলের ছেলে ছাত্রলীগ কর্মী রিজভির বিরুদ্ধে সারিয়াকান্দি থানায় জিডি করেন। এ জিডিতে তিনি ছাড়াও চার সাক্ষীর মধ্যে নূর নবীও ছিলেন।
আনোয়ার রহমান আরও জানান, গত ২৯ আগস্ট দুপুরে ‘৯৯৯‘ নম্বরে দুবার আলাদা নম্বর থেকে সৌরভ ও তার বোন সাথী ফোন দিয়ে ছাত্রলীগ নেতা শ্রাবণ ও বোরহানকে মিথ্যা অপহরণ করার অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর অভিযানে তারা উদ্ধার হন। পরে তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, সৌরভ মণ্ডলের কথায় তারা ওই অপহরণ নাটক করেন। এছাড়া দুটি মিথ্যা অপহরণ মামলায় আনোয়ারকে ফাঁসানোর চেষ্টা করে। সে ঘটনায় নুর নবী ওইদিন বোরহান উদ্দিনকে খুঁজে বের করতে সহায়তা করেন। পরবর্তীতে নূর নবী পুলিশকে ইউনুস, লাড্ডু মণ্ডল ও ফুলবাবুর বাড়িঘর চিনিয়ে দেন। এছাড়া একই দিনে বগুড়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের ৬ষ্ঠতলায় দরজার সামনে আনোয়ার রহমানের স্ত্রীর উপর সৌরভরা হামলা ও জখম করে। এর প্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানায় মামলা করা হয়।
আর এ কারণে বিএনপি কর্মী কোয়েল মণ্ডল ও সৌরভ মণ্ডল, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. ইউনুস, তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা শ্রাবণ, ছাত্রলীগ ক্যাডার রিজভি, মৃত ফুলবাবু মণ্ডলের ছেলে বোরহান উদ্দিন খুশি হননি। তারা নুর নবীর ওপর ক্ষুব্ধ হন। আর তারাই ষড়যন্ত্র করে নূর নবীকে কাজের নামে ডেকে নিয়ে হত্যার পর লাশ বাঁশের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেয়। নূর নবী মারা যাওয়ার পর থেকে সৌরভ গা-ঢাকা দেন। আনোয়ার রহমান আরও বলেন, এ ব্যাপারে প্রশাসন সুষ্ঠু তদন্ত করলেই নূর নবী হত্যার বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
এদিকে আসামিদের বাঁচাতে ও একই পরিবারের ঘটনা হওয়াতে তাদের আত্মীয় সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম মন্টু, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কৃষক দল নেতা মাছুদুর রহমান হিরু মণ্ডল ও প্রভাবশালীরা তদবির অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ উঠে। তবে হিরু মণ্ডল দাবি করেছেন, এসবের সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এ প্রসঙ্গে সারিয়াকান্দি থানার ওসি জামিলুর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্তে রাজমিস্ত্রি নূর নবী আত্মহত্যা করেছেন বলে মনে হয়। এরপরও ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে তার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত হওয়া যাবে।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনার পর সেনাবাহিনী, সিআইডি পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের ছায়া তদন্ত চলমান রয়েছে। তাদের রিপোর্টেও বিষয়টি পরিষ্কার হবে।