মামলার জালে কণ্ঠশিল্পী মমতাজের ফেরারি জীবন
মতিউর রহমান, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২০ পিএম
প্রায় এক যুগ আগে মানিকগঞ্জের সিংগাইরের গোবিন্দল গ্রামে আলোচিত ৪ জন গ্রামবাসী নিহতের ঘটনায় দায়ের করা পৃথক তিনটি হত্যা মামলার জালে মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম ফেরারি জীবনযাপন করছেন।
এছাড়া জেলার হরিরামপুর থানায় দায়ের করা নাশকতা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায়ও প্রধান আসামি মমতাজ বেগম।
এদিকে পৃথক তিনটি হত্যা মামলার আসামি সংখ্যা ৯৬৬ জন। তাদের মধ্যে নামীয় আসামির সংখ্যা ২৮১ জন হলেও গ্রেফতার প্রায় শূন্যের কোঠায়।
তবে সিংগাইর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর রোববার যুগান্তরকে জানালেন, এ পর্যন্ত চারজনকে তারা গ্রেফতারে সক্ষম হয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও দায়ের করা মামলার অভিযোগ সূত্রে, সিংগাইর উপজেলার গোবিন্দল গ্রামে ২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ১০টার হতে দুপুর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ইসলামী সমমনা রাজনৈতিক দলসমূহের পূর্বঘোষিত সকাল-সন্ধ্যা হরতাল সফল করতে সিংগাইর গোবিন্দল নতুনবাজার চার রাস্তার মোড়ে হেমায়েতপুর টু মানিকগঞ্জগামী আঞ্চলিক মহাসড়কে হরতালের কয়েকশ ধর্মপ্রাণ মানুষ জড়ো হন।
বিশাল গণজমায়েত পণ্ড ও ছত্রভঙ্গ করতে বিগত স্বৈরশাসক সরকারীদলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশের ছোড়া গুলিতে ঘটনাস্থলসহ হাসপাতালে নেওয়ার পর স্থানীয় চার গ্রামবাসী নিহত হন।
নিহতরা হলেন- মজনু মোল্লা, ইউসুফ আলী, আলমগীর হোসেন, নাজিম উদ্দিন ও শাহ আলম। নিহত সবাই গোবিন্দল গ্রামের বাসিন্দা।
এদিকে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনার পরপরই মামলা করতে গেলে তাদের মামলা গ্রহণ করেনি স্থানীয় সিংগাইর থানা পুলিশ।
আলোচিত ৪ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার প্রায় এক যুগ পরে ৯ অক্টোবর প্রথম মামলাটি করেন গোবিন্দল ট্র্যাজেডির শিকার নিহত গোবিন্দল গ্রামের ইউসুব আলীর ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম (৫০)। পরে একে একে আরও দুটি মামলা দায়ের হয়। দায়েরকৃত পৃথক তিন মামলার দুটিতে প্রধান আসামি করা হয় মমতাজ বেগমকে; বাকি একটির প্রধান আসামি করা হয় জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বলধরা ইউনিয়নের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ খানকে।
এ পর্যন্ত দায়ের করা পৃথক তিনটি হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা, সিংগাইর উপজেলা পরিষদ ও সিংগাইর পৌরসভার মেয়র ও ইউনিয়ন পর্যায়ের একাধিক চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য মিলিয়ে ৯৬৬ জনকে। সাবেক এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজের ঘাড়ে তিনটি হত্যা মামলার বোঝা।
সর্বশেষ ৪ নভেম্বর দায়ের করা হত্যা মামলায় মমতাজের পাশাপাশি আরও আসামি করা হয়েছে তৎকালীন মানিকগঞ্জ সদর সার্কেলের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার,ডিবি পুলিশের একাধিক পরিদর্শক ৩৭ পুলিশ সদস্যসহ ৮২ জনের নামে ও অজ্ঞাত আরও ২৫ জন মিলিয়ে সহ ১০৭ জনের বিরুদ্ধে।
সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিংগাইরে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন নিহত আলমগীর হোসেনের স্ত্রী সিংগাইরে গোবিন্দল মোল্লাপাড়া গ্রামের মো. রফেজ উদ্দিনের মেয়ে রাফেজা (৩৭)।
মামলার বাদী নিহত আলমগীর হোসেনের স্ত্রী রাফেজা অভিযোগ করেছেন ঘটনার সময় পুলিশ আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ দায়িত্ব পালন না করে উল্টো পুলিশের পোশাক পরিধান করে এলোপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করে হত্যাকাণ্ডে অবৈধভাবে অংশগ্রহণ করেন।
দায়ের করা মামলায় আরও আসামি হলেন- মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও বলধরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মাজেদ খান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শহিদুর রহমান ভিপি শহিদ (৫০), সদ্য বিদায়ী উপজেলা চেয়ারম্যান সায়েদুল ইসলাম (৫০)। এছাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রমজান আলী চেয়ারম্যান, শওকত হোসেন বাদল, সিংগাইর দলিল লেখক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিমপুরের মৃত নুরুল হক ফকিরের ছেলে মনিরুল ইসলাম পলাশসহ (৪০) ৮২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাত আরও ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এছাড়া আসামি পুলিশ সদস্যরা হচ্ছেন- তৎকালীন দায়িত্ব থাকা মানিকগঞ্জ সদরের সার্কেল সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ ডিবি পুলিশের ওসি মো. মহিবুল আলম, মদন মোহন বণিক, মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম, সিংগাইর থানার এসআই আদিল মাহমুদ, মোজাম্মেল হোসেনসহ ৩৭ জন।
এর আগে একই ঘটনায় গত ২৫ অক্টোবর নিহত নাজিম উদ্দিন মোল্লার পিতা সিংগাইর পৌর এলাকার গোবিন্দল গ্রামের মজনু মোল্লা (৬০) বাদী হয়ে সাবেক এমপি সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের পাশাপাশি একই আসনের সদ্য সাবেক স্বতন্ত্র এমপি মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের অর্থ বিষয়ক সম্পাদক দেওয়ান জাহিদ আহমেদ টুলুসহ সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের ১০৯ জন নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ জনকে আসামি করা হয়।
অপরদিকে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে হামলা ও দলীয় নেতাকর্মীদের মারধরসহ জেলা বিএনপির সভাপতি আফরোজা খান রিতার বাসভবন ভাঙচুরের ঘটনার প্রায় আড়াই বছর পর মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাবেক এমপি কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগমের বিরুদ্ধে নাশকতা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে।
হরিরামপুর উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন খান দুলাল বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ৮৬ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ৬০ জন আসামি করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে সাবেক এই এমপি আত্মগোপনে থাকায় তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে বন্ধ পাওয়া যায়।
সিংগাইর থানার ওসি মো. জাহিদুল ইসলাম জাহাঙ্গীর বলেন,পৃথক তিনটি হত্যা মামলার একটি তার থানায় হয়েছে। বাকি দুটি মামলা আদালতে দায়ের করা হয়। এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।