Logo
Logo
×

সারাদেশ

পাহাড়ের মানুষের মূর্তিমান আতঙ্ক খোরশেদ ডাকাত

Icon

ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:২৬ পিএম

পাহাড়ের মানুষের মূর্তিমান আতঙ্ক খোরশেদ ডাকাত

মৌজার নাম কোচক্ষিরা, মানাজি ও সন্ধানপুর। ঘাটাইল সদর থেকে এ মৌজা ৩টির দূরত্ব ১০ কি.মি। দূরত্বের দিক দিয়ে খুব একটা বেশি না হলেও এলাকাগুলো অনেকটাই দূর্গম। পাহাড়ি লাল মাটি। আঁকাবাঁকা সরু রাস্তা। চারিদিকে সংরক্ষিত বন আর শাল গজারি। ওই এলাকার সন্ধানপুর নামক গ্রামের বাসিন্ধা মৃত নবাব আলীর ছেলে খোরশেদ। অভাব অনটনে এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরাতো তার। সারাদিন কামলা খেটে চলতো সংসার। 

৮০-এর দশকের পর অত্র বন এলাকায় উডলট বাগান সৃষ্টির উদ্দেশে বনঅধিদপ্তর ও উপকারভোগীদের মধ্যে চুক্তি হয়। এতে বনঅধিদপ্তর ৪৫% ও উপকারভোগী ৪৫% অর্থ পাবে এবং ১০% অর্থ জমা থাকবে টিএফ ফান্ডে। এভাবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে শুরু হয় বনায়ন কার্যক্রম। প্রকাশ্যে চলে শাল-গজারি কাটার মহোৎসব। ওই সময় বন কর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন খোরশেদ। 

খোরশেদ বাহিনীর উত্থান তখন থেকেই। প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে শাল-গজারি কেটে প্রকৃতির সবুজায়নকে ধ্বংস করে বৃক্ষ শূন্য করা হয়। লাগানো হয় সামাজিক বনায়নের আকাশমনি গাছ। ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে গাছগুলো অনেক বড় হয়ে যায়। তখন খোরশেদ বাহিনীর কুড়ালের থাবা পড়ে আকাশমনি গাছে। অন্য যেকোনো গাছের চেয়ে এ গাছের ফার্নিচার ভালো হয়। ফলে দামও বেশি। 

বন কর্তাদেরও সঙ্গে মিলেমিশে আকাশমনি প্লটের গাছ কাটার মহোৎসবে মেতে উঠে খোরশেদ বাহিনী। প্লটের অংশীজনেরা বাধা দিলে তাদেরকে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ি কয়েকটি এলাকায়। প্লটের গাছ কেটে বিক্রি করে অল্প দিনেই অর্থবিত্তের মালিক বনে যায় খোরশেদ বাহিনী। একচ্ছত্র আধিপত্য এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। এলাকায় পরিচিতি পায় খোরশেদ ডাকাত হিসেবে। 

বর্তমানে পাহাড়ি কয়েকটি এলাকার মানুষের মূর্তিমান আতঙ্ক খোরশেদ বাহিনীর প্রধান খোরশেদ ডাকাত। তার অত্যাচারে অতিষ্ট এলাকাবাসী মুখ খুলতে সাহস পায় না। প্রতিবাদ করলেই নেমে আসে খোরশেদ বাহিনীর খড়গ। বর্তমানে একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে হাজতবাসি হওয়ার পর এলাকাবাসী মুখ খুলতে শুরু করেছে। তার অপরাধ কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় স্থানীয় দুই জন ইউপি মেম্বারের উপর হামলা করার অভিযোগ রয়েছে। 

এছাড়া গত ৪/৫ মাস আগে কোচক্ষিরা এলাকার স্থানীয় খামারের মালিক বায়েজীদ খানের ভাগ্নে জাহিদ খানকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করা হয়।

এদিকে ২০১৪ সালের ২ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৪ আগষ্ট পর্যন্ত ঝড়কা বিটের বিট কর্মকর্তা ছিলেন ওয়াদুদুর রহমান ফরেষ্টার। ওই সময় ওই বিটের আওতায় একযোগে সংরক্ষিত বনের ১২টি প্লটের সম্পূর্ণ গাছ কেটে বিক্রি করে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসে খোরশেদ বাহিনীর প্রধান খোরশেদ ডাকাত ও ফরেষ্টার ওয়াদুদুর রহমানের নাম। 

চলতি বছরের প্রথম দিকে ওই ফরেষ্টার ওয়াদুদুর রহমান বদলি হয়ে বিট কর্মকর্তা থেকে স্থানীয় ধলাপাড়া রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। ফলে ৬টি বিটের প্রধান রেঞ্জ কর্মকর্তা হওয়ায় এ যেন ভালুকের হাতে খোন্তা পাওয়ার মতো। পূর্বের মতোই চিরচেনা সেই খোরশেদ বাহিনীকে হাত করে সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে কলা চাষ করা হয়েছে। রেঞ্জ কর্মকর্তার মদদে ২০১১ সালে সৃজিত সামাজিক বনায়নের ৩৭টি প্লটের আকাশ মনি বাগান সমুলে কেটে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে মুথা উপড়ে ফেলে ওই জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ করে কলার বাগান করা হয়েছে। 

স্থানীয়রা জানান, খোরশেদ বাহিনীর প্রধান খোরশেদ ডাকাতের দখলে রয়েছে বনবিভাগের প্রায় ১০০ একর জায়গা। এর মধ্যে ২৫ একর জায়গায় কলার বাগান করেছেন। ইতিমধ্যে তিনি ৫৪ লাখ টাকার কলা বিক্রি করেছেন। এ ছাড়া বনবিভাগের বেদখলি ভূমি অন্যের কাছে অলিখিত লিজ দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

কোচক্ষিরা মৌজার ১নং দাগের আরএস মালিক আ. হক খান ও মাজেদা খানম। ভুক্তভোগী বায়েজিদ খান জানান, আমি প্রবাসে ২০ বছর ছিলাম। ওই সময় আমার বাড়ির সকল লোকজনকে হত্যার হুমকি দিয়ে জোড়পূর্বক আমার জমি দখল করে। আমি বাড়ি এসে ওই ক্ষেত দখলে নিলে রোববার দিবাগত রাত ৮টার দিকে দেশিয় আস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে আমার বাড়িতে হামলা করে। দুই জনকে গুরুতর আহত করে। এ ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, মাঠ জরিপে আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের পৈত্তিক সম্পত্তি বনবিভাগের নামে রেকর্ড হয়। পরে বনবিভাগ উক্ত জায়গা স্থানীয় মজিবর ও খাদেমের নামে প্লট দেয়। খোরশেদ ডাকাত ওই প্লটের গাছ কেটে বেদখল করে কলার বাগান করে।

বনের জমি কীভাবে দখলে রেখেছে জানতে চাইলে ধলাপাড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা ওয়াদুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন,ওই গুলো বনবিভাগের জায়গা না। ওই গুলি সেনানিবাসের জায়গা। শুনেছি এগুলি নাকি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে লিজ নিয়েছে খোরশেদ ডাকাত। 

তার বিরুদ্ধে কোনো বনের মামলা আছে কী না জানতে চাইলে বলেন-তার বিরুদ্ধে বনবিভাগের অনেক মামলা রয়েছে। আনুমানিক ২০/২৫টা হবে। 

অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খোরশেদ বাহিনী যে জায়গায় কলা চাষ করেছেন ওই জায়গা ২০১১ সালের চুক্তি নামায় ৩৭ জন উপকারভোগীর নামে আলাদা আলাদা প্লট দেও য়া হয়েছিল। বর্তমানে ওই প্লটের জায়গায় কলা চাষ করেছে খোরশেদ ডাকাত বাহিনী।

সাবেক ইউপি মেম্বার হায়দার আলী জানান, খোরশেদ নাম হলেও এলাকা মানুষ তাকে খোরশেদ ডাকাত হিসেবেই চিনে। নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার প্রতিবাদ করায় আমাকে মেরে ফেলার উদ্দেশে একদিন রাতে আমার বাড়ি ঘেরাও করে। গত সংসদ নির্বাচনের পরের দিন পথরোধ করে আমাকে বেদম মারপিট করে। এ ব্যাপারে থানায় জিডিও করেছি। তার বিরুদ্ধে থানা ও বনবিভাগে ৫৬টি মামলা রয়েছে। 

 জানতে চাইলে-ঘাটাইল থানা ওসি রকিবুল ইসলাম বলেন, খোরশেদের বিরুদ্ধে থানায় ৬টির মতো ফৌজদারি মামলা রয়েছে। সর্বশেষ মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম