Logo
Logo
×

সারাদেশ

হাতির মৃত্যুতে গ্রামছাড়া এলাকাবাসী, অর্থ সংকটে পরিবার

Icon

নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৪ পিএম

হাতির মৃত্যুতে গ্রামছাড়া এলাকাবাসী, অর্থ সংকটে পরিবার

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার গারো পাহাড়ের বাতকুচি গ্রামে জেনারেটরের তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বন্যহাতি মারা গেছে।

এ ঘটনায় বন বিভাগ বন্যপ্রাণী আইনে ১১ জন গ্রামবাসীর নামে মামলা দায়ের করে দুইজনকে জেলহাজতে পাঠিয়েছে। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি জেলহাজতে এবং পালিয়ে থাকায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে পরিবারগুলো। তারা দ্রুত মামলার প্রত্যাহার ও হাতির আগ্রাসন বন্ধের দাবি জানান। 

গ্রামবাসী জানান, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে গারো পাহাড়ে বন্যহাতির তাণ্ডব চলছে। হাতিগুলো বেপরোয়াভাবে জমির ফসল, বাড়িঘরে ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। অব্যাহত এ তান্ডব থেকে রক্ষা পেতে কয়েক মাস আগে বন বিভাগের পরামর্শক্রমে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীদের আর্থিক সহযোগিতায় একটি জেনারেটর ক্রয় করা হয়। যাতে হাতির পালকে পাহাড় থেকে লোকালয়ে আসা ঠেকানো যায়। 

গত প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বাতকুচি পাহাড়ে অবস্থান নেওয়া ৩০/৩৫টির বন্যহাতির দলটি যাতে ফসলের জমিতে না আসতে পারে গ্রামবসীরা সম্মিলিতভাবে জেনারেটরের আলো দিয়ে হাতি প্রতিরোধের চেষ্টা করে। গত শুক্রবার এ জেনারেটরের তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি হাতি মারা যায়। 

খবর পেয়ে ওই গ্রামের ভ্যানচালক শহিদুল ইসলাম (৪০) তার ভ্যান গাড়ি নিয়ে হাতির মরদেহ দেখতে যায়। সেখানে বন বিভাগের মধুটিলা রেঞ্জের রেঞ্জার রফিকুল ইসলাম জেনারেটরটি জব্দ করে, শহিদুলকে তার ভ্যান গাগিতে করে তারেঞ্জ অফিসে পৌঁছে দিতে বলে। 

শহিদুল জেনারেটর নিয়ে রেঞ্জ অফিসে গেলে, তাকে আটক করে হাতি হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। শুধু শহীদুল নয়, এ মামলায় জড়ানো হয় আরও ১১ জনকে। বর্তমানে শহীদুল ও ইব্রাহীম নামে দুইজন জেল হাজতে রয়েছে। এমনটাই জানালেন গ্রামবাসীরা। 

শহীদুলের স্ত্রী জামেলা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে জানালেন, প্রায় ১৬ বছর আগে আমার শ্বশুর সোহরাব আলীকে বন্যহাতির দল বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা করে। আমরা সেখান থেকে ভয়ে এই বাতকুচি গ্রামে ১০ শতক এলটের জমি কিনে বাড়ি করে থাকি। আমাদের আবাদি কোন জমি নাই। স্বামী ভ্যানগাড়ি চালিয়ে যে টুকু উপার্জন করে, সেটুকু দিয়েই তিন ছেলেমেয়ে জীবন কাটাই। গত কয়েকদিন আগে মাসিক ১১ হাজার টাকা কিস্তিতে ব্র্যাক থেকে এক লাখ টাকা ও ১ হাজার চারশ পঞ্চাশ টাকা কিস্তিতে ৫০ হাজার টাকা ঋণ করে একটি অটোরিকশা কিনে ছেলে জামিল হোসেনকে দেই। বাবা-ছেলের আয়ে কিস্তি পরিশোধ করে সামনের দিনগুলো পাড়ি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে স্বামীকে হাতি হত্যা মামলায় আসামি করে জেলহাজতে পাঠানোয় এ মাসের কিস্তি দিতে পারি নাই। ঘরে খাবারও নাই। তিনটা ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব কষ্টে আছি।


তিনি বলেন, আমার শ্বশুরকে হাতি হত্যা করেছে, কোন সহযোগিতা পাই নাই। মানুষের চেয়ে এখন হাতির দাম বেশি। আমার স্বামীকে হাতি হত্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। 

গ্রামবাসী বলেন, বনবিভাগের পরামর্শ ক্রমেই ফসল, বাড়িঘর রক্ষা করতে জনপ্রতিনিধি ও গ্রামাসিদের চাঁদায় জেনারেটরটি কেনা হয়েছে। সেদিন যে হাতিটি মারা গেছে  সেটি নিছক দূর্ঘটনা। এতে ১১ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুইজন নিরীহ গ্রাবাসীকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। বাকিরা গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার অনেককে হাতি হত্যায় জড়ানোর ভয় দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।  মামলায় গ্রেফতার ও পালিয়ে থাকা পরিবারগুলো এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। তারা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। 

সোমবার দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বাতকুচি এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, গত ১ নভেম্বর শুক্রবার বাতকুচি গ্রামের যে স্থানে জেনারেটরে তারে বিদ্যুতায়িত হয়ে হাতিটি মারা যায়, সেটি গারোপাহাড়েরই টিলা। পুরো গ্রামে দুই শতাধিক পরিবার বসবাস করলেও চারপাশে সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই। বেলা ৪টার দিকে ছোটবড় ২৬ টির হাতির দল পাহাড় থেকে নেমে এল ধানের খেতে। গ্রামবাসীরা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে হাতির দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চেহারায় শুধু আতঙ্কের ছাপ বিরাজ করছে। 

গ্রামের গোলাম মাওলা জানালেন, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। অর্থ সংকটে আর সামনে যেতে পারিনি। নিজের এক একর জমিতে ধান লাগিয়েছিলাম। পুরোটাই এখন হাতির পেটে।

তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বন বিভাগ শুধু কাগজে-কলমে ক্ষতিপূরণের কথা বলে। বাস্তবতা ভিন্ন। 

গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ সাইদুল ইসলাম জানান, ১৫ বছর যাবৎ আমি গ্রামের মাদ্রাসার শিক্ষকতা করছি। এটি একেবারে পাহাড়ের ভেতর। দিন আর রাত নাই, সবাই আতঙ্কে থাকেন। এই বুঝি হাতি এলো। আমরা এখানে খুব অনিরাপদ বসবাস করছি।

বাতকুচি গ্রামে পাহাড়ের ঢালে বেশ কিছু ধানের জমি। এই পাহাড়ে গত ১০ দিন ধরে ৩০-৩৫টি হাতির দল অবস্থান করছে। দিন রাত যখন তখন হাতি দল নেমে পড়ছে পাকা ধানের খেতে। আগে মানুষ ফসল রক্ষার জন্য মশাল জ্বালিয়ে হৈ-হুল্লোর করে হাতি প্রতিরোধ করতে যেত। কিন্তু জেনারটেরের তারে হাতি মারা যাওয়ার পর, মামলা এবং গ্রেফতার হওয়ার পর আর কেউ এগিয়ে আসছে না। এগিয়ে আসছে না বন বিভাগও। হাতিরা নির্বিঘ্নে ফসলের মাঠে নেমে, ফসল খেয়ে, পিষ্ট করছে। আর মানুষ আতঙ্কক নিয়ে হাতির দিকে তাকিয়ে আছে। 

পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বিএনপি নেতা ওমর ফারুক, গ্রামের বাসিন্দা সুরুজ্জামান, সাবেক সংরক্ষিত আসনের মহিলা মেম্বার সহ অনেকেই জানালেন, হাতি এলাকায় এত ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে, বন বিভাগের কোন সহযোগিতা নেই। উল্টো মামলা দিয়ে গ্রামের মানুষকে আতঙ্কে রেখেছে। দিন আনা দিন খাওয়া দুইজনকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। তারা দ্রুত মামলা প্রত্যাহারসহ হাতি সম্যাসার স্থায়ী সমাধানের দাবি জানান। 

জানতে চাইলে বনবিভাগের মধুটিলা রেঞ্জ কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বন বিভাগের পরামর্শক্রমে জেনারেটর স্থাপন করা হয়েছে, গ্রামবাসীদের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অপরাধ ঢাকার জন্য এখন তারা অনেক কিছুই বলবে। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেহেতু আমার বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার নেই, তাই আমি এর চেয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। 

শেরপুর সহকারী বনরক্ষক সাদিকুল ইসলাম খান বলেন, জেনারেটরের তারে বিদ্যুতায়িত হয়েই হাতিটি মারা গেছে। প্রমাণ পেয়েই আমরা মামলা দায়ের করেছি এবং দুইজনকে ধরে আদালতে সৌপর্দ করেছি। তারা বর্তমানে জেলহাজতে রয়েছে। এ মামলার বাকি অভিযুক্তদেরও ধরার জন্য অভিযান পরিচালনা করছি। যাদের ক্ষতি হয়েছে, আবেদন করলে আমরা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করব। 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম