গাজীপুরে রিকশাচালক থেকে কোটিপতি কমল
শাহ সামসুল হক রিপন, গাজীপুর
প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪২ পিএম
বাংলা ছায়াছবির মতো ভাগ্যবদলের আশায় প্রায় ৩০ বছর আগে গাজীপুর এসেছিলেন শেরপুরের কামাল হোসেন ওরফে কমল। জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম কামাল হোসেন হলেও সবাই তাকে ডাকে কমল নামে।
কমলের পৈতৃক ভিটা শেরপুরে হলেও গাজীপুর থাকার সুবাদে ভোটার কার্ডে ঠিকানা গাজীপুর সিটি করপোরেশন মধ্যপাড়া এলাকায়।
গাজীপুরে এসে প্রথমে থাকার জায়গা না থাকলেও এখন তিনি থাকেন নিজস্ব দোতলা বাড়িতে। জীবিকার তাগিদে প্রথমে রিকশা চালালেও পরবর্তীতে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) গাজীপুর সার্কেলে দালালি করে বনে গেছেন বাড়ি, গাড়ি, জমির মালিক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কমল প্রথমে ৯০-এর দশকে গাজীপুরে আসেন। তখন গাজীপুর শহরের রথখোলা শহীদ বরকত স্টেডিয়াম এলাকায় থাকতেন তিনি। সেখানে থেকে স্টেডিয়াম সংলগ্ন বাবলার গ্যারেজের রিকশা চালাতেন। পরে সিটি করপোরেশনের ভুরুলিয়া এলাকার কলম খার দ্বিতীয় সংসারের মেয়েকে বিয়ে করেন। ২০০০ সালের দিকে কমল বাসের হেলপারি শুরু করেন। পরবর্তীতে হেলপারি ছেড়ে বাসের সুপারভাইজারি শুরু করেন। কয়েক বছর পরে আবার বাসের ড্রাইভারি শুরু করেন।
পরবর্তীতে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন ড্রাইভারি ছেড়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে রাজবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ডের সিরিয়াল মাস্টারের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এরপর গাজীপুর মহানগর ছাত্রলীগের এক সাবেক নেতার সহানুভূতি পেয়ে কমল বেপরোয়া হয়ে উঠেন। সেই সময় রাজবাড়ি স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি চালাতে হলে কমলের মাধ্যমে ভর্তি ফি হিসেবে দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দিতে হতো।
এছাড়াও রাজবাড়ির সামনে কেউ ভাসমান দোকান দিতে চাইলেও কমলকে টাকা দিতে হতো। পরিবহণ স্ট্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে কমল গাজীপুর বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত শুরু করেন।
এরপর যখন দেখলেন বিআরটিএ অফিসে দালালি করলে আয় আরও বেশি তখন স্ট্যান্ডের দায়িত্ব ছেড়ে বিআরটিএ অফিসে দালালি শুরু করেন। এরপরই ভাগ্য বদলে যায় কমলের।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, কমলের নামে একটি এলিয়ন গাড়ি রয়েছে; যার বাজার মূল্য ৪০ লাখ টাকা। সিএনজি রয়েছে ৮টি।
গাড়ি ছাড়াও কমলের রয়েছে মহানগরীর ভুরুলিয়া এলাকায় একটি দোতলা বাড়ি; যার বর্তমান মূল্য আনুমানিক ৭০ লাখ টাকা। এছাড়াও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ধীরাশ্রম বাইপাস সড়ক মাইওয়ান কারখানার সঙ্গে আনুমানিক ৪০ লাখ টাকা মূল্যের ৩ কাঠার একটি প্লট রয়েছে কমলের।
আরও জানা যায়, জয়দেবপুর রেলক্রসিং কলাপট্টি সড়কে চলাচল করা কমলের কয়েকটি অটোরিকশা রয়েছে।
শুধু বিআরটিএতে দালালি নয়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে গাজীপুর সদর মেট্রো থানা শ্রমিক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদও বাগিয়ে নেন। পদ পাওয়ার পরে কমল আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বলেন, পদ পাওয়ার পরেই কমল শহরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যানার ফেস্টুন টাঙিয়ে দেন। পদ পাওয়ার পরে নিজের নাম এবং ফোন নম্বর দিয়ে ভিজিটিং কার্ড ছাপান কমল। এরপর গাজীপুর বিআরটিএসহ নিজের ভিজিটিং কার্ড বিভিন্ন স্ট্যান্ডের সিএনজি চালকের কাছে ছড়িয়ে দেন। পূর্বে স্ট্যান্ডে কাজ করার পরিচিতি এবং শ্রমিক লীগের পদ পাওয়ায় কমলের ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, ফিটনেস এবং মালিকানার কাজও বেড়ে যায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কমল প্রতিদিন গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সোনালী ব্যাংক সংলগ্ন চায়ের দোকানের পাশে অবস্থান করেন। এছাড়াও সার্বক্ষণিক গাজীপুর বিআরটিএ অফিসের উপরে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রুম দাপিয়ে বেড়ান। প্রতিদিনই দেখা যায় কমল গাড়ির বিভিন্ন কাগজপত্র বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত করেন। এছাড়াও চায়ের দোকানের পাশেই কাজের লেনদেন করেন।
কমলের সিএনজির কাগজ করে দেওয়ার একটি ভিডিও এসেছে প্রতিবেদকের কাছে। ভিডিওতে দেখা যায়, শহরের রাজদীঘিপাড়ে একজন চালকের কাছ থেকে সিএনজির কাগজপত্র হাতে নিয়ে দেখছেন। পরে কত টাকায় করবেন সেই বিষয়ে ফয়সালা করে কাগজ নিয়ে চলে যান বিআরটিএ অফিসে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পরিবর্তন হলেও কমলের দাপট রয়েছে আগের মতোই। প্রতিদিন বিভিন্ন কাজ নিয়ে কমলের বিআরটিএ অফিসে যাতায়াত চলছেই।
জানতে চাইলে কমল বলেন, আমার ভোটার কার্ড ব্যবহার করে কিশোরগঞ্জের একজন সিএনজির নম্বর করে নিয়ে গেছে।
সম্পদের বিষয়ে তিনি অস্বীকার করে বলেন, শেরপুরের মায়ের জমি বিক্রি করে বাড়ি করেছেন আর ব্যাংক লোন নিয়ে এলিয়েন গাড়ি কিনেছেন।