জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা, নদীসহ চর থেকে বালু উত্তোলন
যুগান্তর প্রতিবেদন, পটুয়াখালী
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১০:২৭ এএম
পটুয়াখালী জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে ইলিশের প্রজনন মৌসুমে পায়রা বন্দর সংলগ্ন রাবনাবাদ ও পাটুয়া নদীসহ জেলার বিভিন্ন চরে অবাধে বালু কাটা হচ্ছে। এতে ইলিশের অবাধ প্রজনন বিঘ্নের পাশাপাশি হুমকিতে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। ভেস্তে যেতে বসেছে মা ইলিশ রক্ষার সব আয়োজনও। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে আগামী ইলিশ মৌসুমে। ইলিশের স্বাভাবিক প্রাপ্যতা নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি বিশেষজ্ঞদের। ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম।
এ সময় ডিম ছাড়ার জন্য সাগর থেকে নদীর মিঠাপানিতে ছুটে আসে মা ইলিশের ঝাঁক। নদীর পানিতে ইলিশের ডিম রূপ নেয় জাটকায়। এ প্রক্রিয়ায়ই ইলিশের বংশবিস্তার হয়।
এ সময়ে ইলিশ প্রজনন নির্বিঘ্নে করতে সাগর মোহনা এবং নদীতে ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন বন্ধে প্রশাসনকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটি। প্রশাসন এবং জেলা উন্নয়ন ও সমন্বয় কমিটির মাসিক সভায় জেলার সব নদীতে বালু উত্তোলন এবং ড্রেজিং না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কিন্তু তাদের এ সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সাগর মোহনা ও নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা। তড়িৎ বালু উত্তোলনের জন্য পটুয়াখালীর নদী ও সাগর মোহনার মাঝখানে স্থায়ীভাবে নোঙর করা রয়েছে বালু কাটার ড্রেজার। এসব চর থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে বাল্কহেড জাহাজে পরিবহণ করে জেলার বিভিন্ন এলাকায় ফেলা হলেও অজ্ঞাত কারণে প্রশাসন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এ নিয়ে আছে ভিন্ন আলোচনাও। প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের ভাগে ভাগে টাকা দিয়েই বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। কেউ কেউ নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে যুগান্তরকে জানান, এ বালু উত্তোলনের সঙ্গে সবসময়ই প্রভাবশালীরা জড়িত থাকেন। তাদের মাধ্যমে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের ম্যানেজ করেই ইলিশের এ প্রজনন মৌসুমের নিষিদ্ধকালীন সময়ে নদী কেটে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এ খাতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার লেনদেনের অভিযোগ রয়েছে। অপরিকল্পিত এ বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলে ও নদী তীরে বসবাসরত মানুষ। পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এতে আতঙ্কে দিন কাটাছে নদী তীরের মানুষের।
কলাপাড়ার রামনাবাদ নদী তীরের চালিতাবুনিয়া মৌজার বাসিন্দা মো. ইয়াকুব আলীসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দা বলেন, রাত-দিন নির্বিচারে নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে তাদের ঘরবাড়ি নদীতে ভেঙে যাচ্ছে। তারা বাধা দিতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি-ধামকির শিকার ও হামলা-মামলা দিয়েও হয়রানি করা হয় তাদের।
চলতি বছর কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী উপজেলার কোনো বালুমহালের সরকারি ইজারা না থাকলেও প্রতিদিন লাখা লাখ ঘনফুট বালু উত্তোলন করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এ প্রভাবশালী চক্র। অপরিকল্পিতভাবে বালু কাটার কারণে ইলিশের প্রজনন বিঘ্নের আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের অ্যাকুয়াকালচার বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. লোকমান আলী বলেন, ইলিশের প্রজননকালীন সময়ে ড্রেজার বন্ধ রাখা খুবই জরুরি। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে ইলিশ মাছ নদীতে যখন ডিম ছাড়ে তখন ডিম পানিতে মিশে যায়। এ সময় ড্রেজার চালানো হলে পানি ও বালুর সঙ্গে অনেক ডিম উঠে আসবে এবং অনেক ডিম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এছাড়া মা ইলিশ যখন ডিম ছাড়বে ড্রেজারের শব্দে তাদের নদীতে মুভমেন্ট করার সময় বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদের ডিন ড. মো. নুরুল আমিন বলেন, অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন করা হলে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বৃদ্ধি পাবে, ফলে নদীতীরে ভাঙন সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কা বাড়বে। এছাড়া নদীগর্ভে যেসব হেভি মেটাল রয়েছে তা পানিতে মিশবে এবং অক্সিজেনের ঘাটতি হবে, এতে বায়োডাইভারসিটি বিনষ্ট হবে। মাছের উৎপাদন কমে যাবে এবং পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাবে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করতে এ সময় নদ-নদীতে সব ধরনের ড্রেজিং বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে টাস্কফোর্স কমিটি।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আরিফ হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট বালুমহাল ছাড়া নদ-নদীতে ড্রেজিং করা হলে তীর ভাঙার একটি প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও এসব অবৈধ ড্রেজিং ঠেকাতে প্রশাসন কাজ করছে। এ বিষয়ে লোড ড্রেজার মেসার্স তায়্যিবা এন্টারপ্রাইজের মালিক এসএম শিপনকে ইলিশের চলমান প্রজনন মৌসুমে অবৈধভাবে বালু কাটার ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মা ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রম চলাকালে নদ-নদীতে ড্রেজিং করা নিষিদ্ধের ব্যাপারে আমার জানা ছিল না। খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
জেলা প্রশাসক আবুল হাসানাত মোহাম্মদ আরেফিন বলেন, বৈধ-অবৈধ বালুমহালগুলোতে ইলিশের চলমান প্রজননকালীন সময়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তা আপনার কাছে শুনলাম। আমি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিচ্ছি।