নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মা-ইলিশ শিকারের উৎসব
মো. মামুন তানভীর, দশমিনা (পটুয়াখালী)
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:১৯ পিএম
৮০ বছরের বৃদ্ধ আলম মিয়া। স্বাধীনতা যুদ্ধসহ নানা ঘটনার সাক্ষী তিনি। জীবনের প্রায় শেষলগ্নে এসে মা-ইলিশের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আফসোস আর আক্ষেপ করে তিনি বলছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পটুয়াখালীর দশমিনায় মা-ইলিশের এমন লুটপাট ও ছিনতাইয়ের ঘটনা কখনো দেখেননি আগে বা শোনেননি।
তার ভাষায়, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মা-ইলিশ শিকারের উৎসব আর অভিযানের নামে ইলিশ রক্ষায় দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাটকীয়তা ও রাজনৈতিক দলের নেতাসহ প্রভাবশালীদের লুটপাটের ঘটনা বিগত সময়ের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
তার ভাষায়, অবরোধের নামে সাজানো নাটকে পয়সা আয় আর লুটপাট চলছে।
তবে ইলিশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্টদের দাবি, যারা অসাধু উপায়ে মাছ নিধনে ব্যর্থ কেবল তারাই মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। তাদের অভিযোগ একেবারেই ভিত্তিহীন।
যুগান্তরের হাতে আসা প্রমাণ ও বিশ্বস্ত সূত্রমতে, বিগত সময়ের তুলনায় চলতি বছরে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞায় মাছ বেচা-বিক্রি আর লুটপাট সবই চলছে প্রকাশ্যে। নিষেধাজ্ঞাকে স্থানীয়রা লোক দেখানো অভিযান বলে আখ্যায়িত করছেন। মা-ইলিশ কেন্দ্রিক এমন কোনো অপরাধ নেই যা হচ্ছে না। প্রতিদিন হাজার হাজার টাকার মা-ইলিশ যেমন ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে ঠিক তেমনিই প্রতিদিন মা-ইলিশ ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। উপজেলা সৃষ্টির পর ইলিশের এমন লুটপাট কেউ আগে দেখেনি।
অন্যদিকে মাছ ইলিশ রক্ষার অভিযান নিয়ে মৎস্য বিভাগ ও নৌ-পুলিশ এবং জেলেদের মধ্যে তেঁতুলিয়া-বুড়াগৌরঙ্গ নদীতে চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা। সংশ্লিষ্টদের নাটকীয়তায় বিব্রত ও ক্ষুব্ধ সচেতন মহল।
নাম না প্রকাশের শর্তে যুগান্তরকে এক জেলে জানান, অপছন্দের জেলেদেরই শুধু শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। আর যাদের সঙ্গে ইলিশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকজনের বিশেষ সখ্যতা রয়েছে তাদের মাছ ধরার সুযোগ দিয়ে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। অবৈধভাবে মাছ শিকার করা জেলেকে ইলিশ রক্ষার দায়িত্বে থাকা লোকজন ও নদীর তীরে থাকা স্বজনরা উপজেলা প্রশাসনের আসার খবর মুঠোফোনে পৌঁছে দিয়ে সতর্ক করেন। ওই সব জেলেরা দিনে-রাতে প্রকাশ্যে মাছ ধরছেন এবং পরবর্তীতে নদীকেন্দ্রিক এলাকায় বিশেষ বাজার বসিয়ে ৩শ থেকে ৪ হাজার টাকায় ইলিশের হালি বিক্রি করছেন। কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাছ বিক্রি করছেন।
ওই জেলের সূত্রমতে, গভীর রাতে মাছ ক্রয় করে বাড়ি ফেরার পথে ক্রেতার মাছ ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে প্রতিদিন। এছাড়া মাছ ধরানো, ক্রয়-বিক্রি ও কখনো কখনো ছিনতাইয়ের ঘটনায় সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি সদস্য, কথিত সাংবাদিক ও ছাত্রদল এবং যুবদল নেতারা জড়িয়ে পড়ছেন বলে অভিযোগ আছে। মাছ হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হলে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুলিশে। দেখানো হচ্ছে ভয়ভীতি।
এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুমুল সমালোচনার ঝড় বইছে। মা-ইলিশকে কেন্দ্র করে এমন তীব্র সমালোচিত ঘটনা এ উপজেলায় আগে ঘটেনি।
খায়ের নামে এক জেলে জানান, সৎ মৎস্য কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম গুরুতর আহত হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকার সুযোগে কেউ কেউ নদী বিক্রি করে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ক্রেতারা অবরোধের মাছ ক্রয়কে উৎসব মনে করে। এ বছর ইলিশ রক্ষা ও লুটপাটের যে নাটকীয়তা হয়েছে তা নজিরবিহীন।
পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মৎস্য বিভাগে শতভাগ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। নদীর পাশে বাড়ি হওয়ায় কখনো কখনো জেলেরা ছোট জাল নিয়ে নদীতে নামছেন। তাদের শাস্তির আওতায়ও আনা হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, তাদের দপ্তরের কেউ অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে ইউএনও ইরতিজা হাসান বলেন, মা-ইলিশ রক্ষায় আমরা সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। আইন প্রয়োগে কোনো দলমত বিবেচনা করা হচ্ছে না। আমি মাত্র কয়েক দিন হলো যোগদান করেছি। এর মধ্যে ১০ বার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অনেককে শাস্তির আওতায় এনেছি। অভিযোগ আসার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।