Logo
Logo
×

সারাদেশ

রাজধানীর ৩ স্বনামধন্য স্কুল ঘিরে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়েন মেনন

Icon

আকতার ফারুক শাহিন, বরিশাল

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৭ এএম

রাজধানীর ৩ স্বনামধন্য স্কুল ঘিরে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়েন মেনন

রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বামধারার রাজনৈতিক নেতা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন।  ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন, তার বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।  গভর্নিং বডির কোনো আইনগত ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও ৪২ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়ার নামে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেন।

সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের হলফনামায় মাত্র ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭১ হাজার ২২৬ টাকার সম্পদ থাকার কথা জানিয়েছিলেন মেনন ও তার স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান। অথচ তাদের রয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ। তদন্তে প্রমাণ মিললে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে মেনন ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র।

নৌকায় ওঠার পর খাতা খোলেন দুর্নীতির : রাশেদ খান মেননের বাবা বিচারপতি আব্দুল জব্বার ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের স্পিকার। কট্টর বাম রাজনীতিক মেনন তখন বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে প্রথম লাইমলাইটে আসেন। ১৯৭৯ সালে আদর্শিক পথে চলা শ্রদ্ধার মানুষ পরিচয়ে তিনি প্রথম সংসদ-সদস্য হন। তার এ ধারা অব্যাহত থাকে ’৯১ সাল পর্যন্ত। সেবার নিজের দল ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা হিসাবে তিনি বরিশাল-২ নির্বাচনি এলাকায় সংসদ-সদস্য হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এসে অবশ্য তিনি পুরোপুরি পালটে যান। ততদিনে তার দলসহ আরও ১৩ দল মিলে গঠিত হয়েছে ১৪ দলীয় জোট। ওই বছর নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির নির্বাচনি প্রতীক কাস্তে, হাতুড়ি ফেলে নৌকা প্রতীকে নিজের নির্বাচনি এলাকা বরিশাল ছেড়ে রাজধানীর ঢাকা-৮ আসনে নির্বাচন করে সংসদ-সদস্য হন মেনন। এরপর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনেও ঘটে একই ঘটনা। নৌকার মাঝি হয়ে সংসদ-সদস্য হন ওয়ার্কার্স পার্টির মেনন। ২০২৪-এর নির্বাচনে আরও একটি দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হন বরিশালের বাসিন্দারা। এবার মেনন ভোট করেন বরিশাল-২ অর্থাৎ উজিরপুর-বানারীপাড়া আসনে। অথচ তার গ্রামের বাড়ি বরিশাল-৩ নির্বাচনি এলাকার বাবুগঞ্জ উপজেলায়। মেননের পৈতৃক বাড়ি বাবুগঞ্জের দেহেরগতী এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ‘২০০৮ সালে নৌকায় ওঠার পর থেকেই মূলত বদলে যান মেনন। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ তাকে দুবার মন্ত্রীও বানিয়েছে। আজন্ম আদর্শের রাজনীতি করে দারিদ্র্যের সঙ্গে থাকা মেনন পালটে যান মন্ত্রী হওয়ার পর। বিত্তবৈভবের নেশায় পেয়ে বসে তাকে। যে কোনো মূল্যে সংসদ-সদস্য হওয়াই মুখ্য হয়ে ওঠে তার কাছে। তাই কেবল আদর্শ কেন, জন্মভূমি আর পিতৃভিটার মানুষকে ছেড়ে যেতেও তিনি দ্বিধা করেননি।’

হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন যেভাবে : ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার নামকরা উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং আইডিয়াল স্কুলের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন মেনন। তার দুর্নীতির হাতেখড়িও মূলত এ তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই। উইলসের সভাপতি থাকাকালে অবৈধ পন্থায় ১২৮ জনকে শিক্ষকসহ স্কুলের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন মেনন। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুস বাবদ তিনি নেন কোটি কোটি টাকা। একই সময়ে প্রতিষ্ঠানের ৪২ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে পদোন্নতি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের অর্থ। অথচ গভর্নিং বডির কোনো আইনগত ক্ষমতা ছিল না পদোন্নতি দেওয়ার। একইভাবে অবসর ভাতা প্রদান, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং অবকাঠামো নির্মাণ খাত থেকে বিপুল অর্থ সরান এই বামপন্থি নেতা। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিল-ভাউচারেও কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে। এক হিসাবে দেখা যায়, সাত বছরের দায়িত্ব পালনকালে এই এক বিদ্যালয় থেকেই তিনি প্রায় ৮০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন। এ সংক্রান্ত একাধিক অভিযোগ দাখিল রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। প্রাথমিক তদন্তে দুদক কর্মকর্তারাও এসব দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন। উইলসের মতোই ভিকারুননিসা এবং আইডিয়ালেও দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য গড়েন রাশেদ খান মেনন। বিদ্যালয়ে সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগের কোনো বিধান না থাকলেও মেনন একক ক্ষমতায় একজন সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ দিয়ে অবকাঠামো খাত নির্মাণে তৈরি করেন কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের সুযোগ। এ দুটি প্রতিষ্ঠানেও নিয়োগ, পদোন্নতিসহ বিভিন্ন খাত দিয়ে টাকা হাতান তিনি। উল্লিখিত তিনটি বিদ্যালয়ে মেনন সবচেয়ে বড় দুর্নীতি করেছেন ভর্তি বাণিজ্যের মাধ্যমে। এ তিনটি স্কুলে শিক্ষার্থীপ্রতি ২ লাখ থেকে ৫ লাখ টাকার ভর্তি বাণিজ্য করে মেনন ও তার চক্র। ৭ বছর সভাপতি থাকাকালে এ ভর্তি বাণিজ্যে মেননের হাজার কোটি টাকা হাতানোর প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর পাশাপাশি বিমান-পর্যটন ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী থাকাকালে এ দুটি মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকেও শত শত কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া নিয়োগ, টেন্ডার বাণিজ্য, সব ধরনের বরাদ্দে কমিশন আদায়, বিমান ক্রয়, অবৈধ বরাদ্দ ও স্বর্ণ চোরাচালানের মতো গুরুতর দুর্নীতির মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে শতকোটি টাকা লোপাটের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুদক।

হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন : আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য, মন্ত্রীদের মতো মেননও হলফনামায় হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন। অবশ্য হলফনামার হিসাবেও লাখ থেকে কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন মেনন ও স্ত্রী লুৎফুন্নেসা খান। মেননের স্ত্রী একসময় চাকরি করতেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে দাখিল করা হলফনামায় নিজের ও স্ত্রীর মিলিয়ে ২৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দেন মেনন। এর মধ্যে নিজের ২৩ লাখ ৬০ হাজার এবং স্ত্রীর মাত্র ৪ লাখ ২৬ হাজার টাকার সম্পদ থাকার কথা তিনি উল্লেখ করেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনেই তাদের সম্পদের পরিমাণ কোটি টাকার ঘরে পৌঁছে যায়। সেবারের হলফনামায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৪০০ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দিয়েছিলেন মেনন দম্পতি। মেননের ৯৬ লাখ ৬ হাজার টাকার সম্পদের পাশাপাশি স্ত্রী লুৎফুন্নেসার সম্পদ দেখানো হয় ২৮ লাখ ৩ হাজার ৪০০ টাকার। হলফনামার হিসাবেই ২০২৪ সালের নির্বাচনেও অব্যাহত থাকে সম্পদ বৃদ্ধির এই ম্যাজিক। এবার দাখিল করা ৩ কোটি ৪৬ লাখ ৭১ হাজার ২২৬ টাকার সম্পদের বর্ণনায় নিজের ১ কোটি ৮৯ লাখ ৫৫ হাজার ৫৭১ টাকার সম্পদের পাশাপাশি স্ত্রীর ১ কোটি ৫৭ লাখ ১৫ হাজার ৬৫৫ টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দেন মেনন। যদিও এসব হলফনামার প্রতিটিতেই মিলেছে ব্যাপক ঘাপলা। ২০২৪ সালের হলফনামায় শেয়ার, চাকরি এবং অন্যান্য মিলিয়ে বছরে তিনি ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৪৫ টাকা বার্ষিক আয়ের তথ্য দেন। দাখিল করা এই হিসাবে মাসে ৫৮ হাজার ২৮ টাকা আয় করা মেনন তার যানবাহনের বর্ণনায় যে গাড়ির মালিকানার কথা লেখেন, এর দাম উল্লেখ করা হয় ৪৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। স্ত্রীর গাড়ির দাম দেখানো হয় এর প্রায় আড়াই গুণ, অর্থাৎ ১ কোটি ১ লাখ ৬ হাজার ৮০০ টাকা। আয়ের সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যয়নির্বাহে এমন অনেক অসংগতির পাশাপাশি সম্পদের প্রশ্নেও তিনি অনেক কিছু গোপন করেন। স্থাবর সম্পদ প্রশ্নে দেড় বিঘা কৃষিজমি আর রাজধানীর পূর্বাচলে ১০ কাঠা অকৃষি জমির কথা উল্লেখ করলেও রাজধানী ঢাকার তোপখানা এবং বরিশালের বাবুগঞ্জে থাকা শতকোটি টাকার পৈতৃক সম্পদের তথ্য তিনি বেমালুম চেপে যান। সেই সঙ্গে গোপন করেন নামে-বেনামে থাকা হাজার কোটি টাকার সম্পদের তথ্যও। পূর্বাচলে ১০ কোটি টাকার একটি প্লট থাকার কথা হলফনামায় উল্লেখ করলেও সেই পূর্বাচলেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কেনা ৫ কাঠার আরও ৪টি প্লট রয়েছে মেনন দম্পতির। সেই তথ্য তিনি দেননি হলফনামা বা আয়কর ফাইলে। ভূমি দপ্তরের রেকর্ডরুম ও রেজিস্ট্রি দলিল অনুযায়ী আরও যেসব সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন মেনন, এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার গুলশান-২, রোড নং-৫, বাড়ি নং-২৭-এ ৪টি ফ্ল্যাট; বনানী রোড নং-৪, বাড়ি নং-১৬তে ২টি ফ্ল্যাট; ঢাকার সাভার ও আশুলিয়ায় ১৬০ বিঘা জমি; কেরানীগঞ্জ দক্ষিণ হাইওয়ে সড়কে ২০ বিঘা জমির ওপর রিসোর্ট এবং বরিশালের উজিরপুরে ৩০০ বিঘা জমিসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি প্লট ও ফ্ল্যাটের তথ্য। আর্থিক মূল্যে এসব সম্পদের দাম কয়েক শ কোটি টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার এফডিআর-শেয়ার, আমেরিকায় চিকিৎসক কন্যার জন্য বাড়ি কেনা এবং লন্ডনেও একাধিক ফ্ল্যাট-বাড়ি থাকার অভিযোগ রয়েছে মেননের বিরুদ্ধে।

পরিচয় না প্রকাশের শর্তে ওয়ার্কার্স পার্টির একাধিক নেতা বলেন, ‘ক্ষমতা আর বিত্তের লোভে শেষের দিকে নীতি-আদর্শ সবই বিসর্জন দেন একসময়কার ডাকসাইটে বাম রাজনীতিক মেনন। নিজে সংসদ-সদস্য হতে গিয়ে দলকেও একপর্যায়ে করে ফেলেন ধ্বংস। আওয়ামী লীগ তথা শেখ হাসিনাকে খুশি রাখতে গিয়ে অবস্থান নেন সাধারণ জনগণ আর দেশের মানুষের একান্ত চাওয়ার বিরুদ্ধে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে স্ত্রীকে সংসদ-সদস্য বানান মেনন। এ নিয়ে দলের ভেতরে সৃষ্টি হয় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার। এমনিতেই মেননের আদর্শহীন কর্মকাণ্ডে ক্ষুদ্ধ ছিলেন দলের তৃণমূল ও মাঠ পর্যায়ের সাধারণ নেতাকর্মী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে স্ত্রীকে সংসদ-সদস্য বানানোর পর আরও তীব্র হয় তা। দলে ত্যাগী, পরীক্ষিত বহু নেত্রী থাকা সত্ত্বেও মেননের এ কাজে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার চরম স্বার্থপরতা ও ক্ষমতার লোভের বিষয়টি। দলের ভেতরেও তাকে তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয়। তবে শেষ পর্যন্ত নিজের চাওয়াতেই অটল থাকেন ক্ষমতা আর বিত্তলোভী মেনন। ৫ আগস্টের পর পলাতক থাকা মেননকে ২২ আগস্ট গুলশান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ হত্যা মামলায় বর্তমানে তিনি জেলহাজতে রয়েছেন। এছাড়া তার অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। দুদকের পক্ষ থেকেই এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম