বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার পতনের পর বিগত সময়ের খুন, গুম, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। কিন্তু সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কিছু সুবিধাবাদী মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের দ্বন্দ্বে অপরকে ঘায়েল করতে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, সাংবাদিক, ব্যাংকার, অ্যাডভোকেট এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিএনপি নেতাদের পরিবারের সদস্যদেরও মিথ্যা মামলায় আসামি করা হচ্ছে। কোর্ট বিল্ডিং কেন্দ্রিক এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মিথ্যা মামলায় আসামি করার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে।
অভিযোগ উঠছে, মামলাবাজরা এজাহার তৈরি করে তা টার্গেট ব্যক্তির হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে বা বিভিন্ন সোর্সে খবর দিয়ে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিথ্যা মামলায় কাউকে জড়ানো হলে, যারা প্রকৃত অপরাধী তারা বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার সুযোগ পাবে।
জানা গেছে, এ ধরনের মিথ্যা মামলার ভুক্তভোগী স্বয়ং চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক এসএ মুরাদ চৌধুরীর পরিবার। মামলা বাণিজ্য চক্রে জড়ানোসহ বিভিন্ন অপরাধের কারণে ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ দপ্তর সম্পাদক নাজিম উদ্দিনকে দল থেকে বহিষ্কার করে যুবদল। এর পরপরই মুরাদ চৌধুরীর বাবা মোহাম্মদ আলীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়েছে। এছাড়া মুরাদ চৌধুরীর চাচা ওসমান গনি ও মুরাদের শ্বশুরের নামে মামলা করা হয়েছে। অথচ মোহাম্মদ আলী বিগত ৬ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করেন। চার মামলার একটির বাদী নাজিম উদ্দিন। তিনি ১০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আদালতে মামলাটি করেন। মামলায় নাজিম নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর তাঁতী দলের যুগ্ম আহ্বায়ক পরিচয় দিয়েছেন। অথচ এই নামে চট্টগ্রাম মহানগর তাঁতী দলের কোনো যুগ্ম আহ্বায়ক নেই। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে মামলাটি করেন তিনি। মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৯ সালে মোহাম্মদ আলীসহ এজাহারভুক্তরা চাঁদাবাজি ও প্লট দখল করেন।
চট্টগ্রাম আদালত ভবনকেন্দ্রিক একাধিক সিন্ডিকেট ৫ আগস্টের পর থেকে মামলা বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে। এই চক্রে কিছু অসাধু আইনজীবী, অসাধু মুন্সি রয়েছেন। চক্রের সদস্যরা এজাহার তৈরি করে টার্গেট ব্যক্তির নাম দিয়ে তা তার কাছে পাঠান। একটি এজাহার একাধিকবার নাম বাদ দিয়ে বা যুক্ত করে পাঠানোর নজিরও রয়েছে। কম্পিউটার টাইপের স্থলে হাতে লেখা নাম যুক্ত করেও মামলা দায়ের করা হয়। আবার লাল কালি দিয়ে নাম কেটে দেওয়ারও নজির রয়েছে। সাংবাদিক ও আইনজীবীদের বিরুদ্ধেও এ ধরনের মিথ্যা মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে মামলা বাণিজ্য চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বরাবর ২৪ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়েছেন এসএ মুরাদ চৌধুরী। চিঠিতে তিনি অভিযোগ করেন, সরকার পতনের পর চট্টগ্রামের গুটিকয়েক ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে একের পর এক মনগড়া মামলা দিয়ে যাচ্ছে। যে মামলাগুলোতে উপরের সারিতে বেশকিছু আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতার নাম দিয়ে শেষের দিকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, প্রবাসী শিক্ষক, ডাক্তার, পেশাজীবীদের আসামি করা হচ্ছে। এমনকি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীকে পর্যন্ত আসামি করা হয়েছে। মামলাগুলো এতটাই মনগড়া ও ভিত্তিহীন যেখানে কিছু মামলার বাদী নিজেই জানে না যে, সে কার বিরুদ্ধে মামলা করেছে, সাক্ষীরা পর্যন্ত জানে না তারা কোন মামলায় সাক্ষী হয়েছেন।
এ ছাড়া মিথ্যা মামলায় আসামি দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে চট্টগ্রামের বাকলিয়া এলাকার মো. রিয়াদকে। পটিয়া উপজেলার পাইরোল গ্রামের তিন সহোদর লোকমান খান, বোয়ালখালী উপজেলা বিএনপির এক নেতার মেয়ের সঙ্গে ২০২২ সালের ৩০ জুন বিয়ে হয় রিয়াদের। কিন্তু পারবারিক অশান্তির কারণে সেই বিয়ে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ভেঙে যায়। এরপর ২০২৪ সালের ১২ মার্চ কাবিন ও ভরণপোষণের মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। এইগুলো আইনিভাবেই মোকাবিলা করেন রিয়াদ। কিন্তু সরকারের পতনের পর ৯, ১২, ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর চারটি মামলায় আসামি করা হয়েছে রিয়াদকে। সব মামলাই আদালতে করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯ সেপ্টেম্বরে দাখিল করা মামলার বাদি ইউসুপ আলী। মামলায় উল্লেখ করা হয়, ৩ আগস্ট মামলার বাদীসহ সঙ্গীদের ওপর হামলা, গাড়ি ভাঙচুর ও আগুন দিয়েছেন আসামিরা। আদালত বোয়ালখালী থানাকে তা এফআইআর হিসাবে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
রিয়াদ বলেন, সব মামলাই রাজনৈতিক। যেখানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। সেই মামলায় আমার নামও কৌশলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সব মামলার ঘটনাস্থল দেখানো হয় বোয়ালখালী। অথচ আমি কোনো রাজনৈতিক দল করি না, আমি কখনো বোয়ালখালী যাইনি, এমনকি সেখানে আমার কোনো আত্মীয়স্বজনও নেই। এমনকি মামলা করার পর কয়েকজন সাক্ষীকে পাঠিয়ে আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিষয়টি দফারফারও প্রস্তাব দেওয়া হয়।
পটিয়া উপজেলার পাইরোল গ্রামের বাসিন্দা তিন সহোদর লোকমান খান, এমদাদ খান ও আনিস এরশাদকে একাধিক মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের সঙ্গে এলাকায় কয়েকজনের জায়গা-জমি নিয়ে পূর্ব বিরোধ রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে মামলাবাজ চক্রের মাধ্যমে তাদের একাধিক মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে প্রতিপক্ষ।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, একটি মামলায় ২০০-৩০০ এমনকি ৫০০ জনকে আসামি করা হচ্ছে নামে-বেনামে। এসব মামলা আদালতে টিকবে না। কারণ অপরাধীর সঙ্গে নিরপরাধ লোকজনকে মামলার আসামি করার কারণে প্রকৃত অপরাধীরাও পার পেয়ে যাবে। মিথ্যা মামলা দায়েরকারী চক্রকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা দরকার।