চউকের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম
চেয়ার টেকাতে মন্ত্রীদের উপঢৌকন দিতেন প্লট
এমএ কাউসার, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০২:২৪ এএম
ফাইল ছবি
রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালে নগর আওয়ামী লীগের অর্থ সম্পাদক আবদুচ ছালামকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ পদে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে ১০ বছর ছিলেন তিনি। আর চেয়ার টিকিয়ে রাখতে সাবেক মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও দলীয় নেতাদের উপঢৌকন দিয়েছিলেন কোটি কোটি টাকা মূল্যের প্লট। এছাড়াও নিজের আত্মীয়স্বজন, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামেও প্লট বাগিয়ে নেন তিনি। তার মেয়াদে চট্টগ্রামে শুরু হওয়া নানা প্রকল্প থেকে কমিশন আদায়ের বিষয়টিও ছিল ওপেন সিক্রেট। বিশেষ করে হাজার কোটি টাকার ফ্লাইওভার প্রকল্প নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে নানা প্রশ্ন ওঠে। চউক চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায়ের পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। চেয়ারম্যান থাকাকালে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৫ জনের মৃত্যু হয়। সেই ঘটনায়ও পার পেয়ে যান তিনি। টাকার জোরে এবং ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে ২০২৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে সংসদ-সদস্য ‘নির্বাচিত’ হন। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকে লাপাত্তা এই ক্ষমতাধর ছালাম।
জানা যায়, অনিয়মের মাধ্যমে চউকের শতাধিক প্লট বরাদ্দ দিয়েছিলেন আবদুচ ছালাম। এর মধ্যে চউকের ৩৮৪তম বোর্ড সভায় জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০টি প্লট এবং ৪০৫তম বোর্ড সভায় মন্ত্রী, সংসদ-সদস্য ও নেতাদের নামে ৬০টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী, যাদের শহরে প্লট-ফ্ল্যাল্ট কিংবা জায়গাজমি রয়েছে, তাদের সরকারি প্লট বরাদ্দ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ছালাম যাদের নামে প্লট বরাদ্দ দিয়েছেন তারা হলেন-সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, দিলীপ বড়ুয়া, ডা. আফসারুল আমীন, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, দীপংকর তালুকদার, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ, বীর বাহাদুর উশৈশিং, সাবেক হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, সাবেক সংসদ-সদস্য ফজলে করিম চৌধুরী, এবিএম আবুল কাশেম, এমএ লতিফ, মাঈনুদ্দিন খান বাদল, চেমন আরা বেগম, মোসলেম উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য একে আজাদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীসহ প্লট পেয়েছেন দলের বিভিন্ন পেশাজীবীরাও। এছাড়া চউকের বোর্ড সদস্য যুবলীগ নেতা কেবিএম শাহজাহান ও জসিম উদ্দিন শাহ, চউক চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত সহকারী তারেক গণির মা জাকিয়া বেগমকেও গোপনে প্লট বরাদ্দ দেন আবদুচ ছালাম।
২০০৪ সালে নগরীর কুয়াইশ ও চান্দগাঁও মৌজায় ১৭০ একর জমিতে গড়ে তোলা হয় অনন্যা আবাসিক এলাকা নামে নতুন আবাসন প্রকল্প। প্রকল্পের নকশা ও লে-আউট অনুযায়ী ২০০৮ সালের জুলাইয়ে ১ হাজার ৭৩৩টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয় লটারির মাধ্যমে। তখন চেয়ারম্যান ছিলেন প্রকৌশলী শাহ মোহাম্মদ আকতার উদ্দিন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে আকতার উদ্দিনকে সরিয়ে আবদুচ ছালামকে চউক চেয়ারম্যান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই নিয়োগ পেয়েই তিনি অনন্যা আবাসিক এলাকায় সরকারি জমির হরিলুট শুরু করেন। ওই আবাসিক এলাকার লেআউট ও নকশা পরিবর্তন করে ভরাট করা হয় পুকুর। নষ্ট করা হয় খেলার মাঠ। এভাবেই প্লট বাড়িয়ে নিজের মালিকানায় গড়ে তুলেন এভারকেয়ার হাসপাতাল। এছাড়া নগরীর ওআর নিজাম রোডে তার মালিকানাধীন একটি আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তর করেন, যেটি বর্তমানে চারতারকাবিশিষ্ট হোটেল ওয়েলপার্ক হিসাবে পরিচিত। অভিযোগ রয়েছে, ১০ বছর চেয়ারে থাকলেও নগরবাসীর আবাসন সমস্যার সমাধানে নতুন কোনো আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করেননি তিনি। উলটো তার আগের চেয়ারম্যান শাহ মোহাম্মদ আকতার উদ্দিনের নেওয়া কল্পলোক আবাসিক (তৃতীয় ফেস) প্রকল্পটি বাতিল করে দেন ছালাম। ওই প্রকল্পের জায়গা নিজের ও আত্মীয়স্বজনের নামে কিনে নিয়ে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করেন তিনি। এ নিয়ে নগরবাসীর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ রয়েছে।
ফ্লাইওভার নির্মাণে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ : নগরীতে তিনটি ফ্লাইওভার নির্মাণ হয় আবদুচ ছালামের আমলে। সব প্রকল্প ছিল হাজার কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজও শুরু হয় তার আমলে। ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা থেকে এ প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯শ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেছেন, পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া, ধাপে ধাপে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোসহ নানা প্রক্রিয়ায় কোটি কোটি টাকার কমিশন ঢুকেছে তৎকালীন চউক চেয়ারম্যানের পকেটে। কাজ পেতে আবদুচ ছালামকে ম্যানেজ করেছিল সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার। একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিতে দরপত্রের শর্তে পরিবর্তন আনারও অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে ওই সময় গণমাধ্যমে সংবাদও প্রকাশ হয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নেতা হওয়ায় কোনো সংস্থাই এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখেনি। এ প্রকল্পের কাজ পেতে ১০টি প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়। বাকি ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বনিু দরদাতা হিসাবে ২ হাজার ৮৫৪ কোটি ৫৬ লাখ টাকায় প্রকল্পের কাজ পায় নির্দিষ্ট ঠিকাদার। চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা প্রকল্পেও মেগা দুর্নীতির অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে।
বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের গার্ডার ধস ও নির্মাণকাজে গাফিলতি : ২০১২ সালের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ভেঙে পড়ে ১৫ জন নিহত হন। আহত হন অনেকে। ওই সময় চউক চেয়ারম্যান হিসাবে আবদুচ ছালামের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। সেসময় বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, ফ্লাইওভার নির্মাণের পদ্ধতিগত ত্রুটি, ঠিকাদারের গাফিলতি, সঠিক তদারকিতে দুর্বলতা এবং উপযুক্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়াতেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় চউক চেয়ারম্যান দায় এড়াতে পারেন না। এ ঘটনায় চান্দগাঁও থানায় একটি মামলা হয়েছিল। যেখানে আসামি করা হয়েছিল কতিপয় প্রকৌশলী ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের। অথচ চউক চেয়ারম্যানকে এ মামলা থেকে রেহাই দেওয়া হয় কেবল আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ার কারণে।
নকশা বদল করে নিজের প্রতিষ্ঠান ওয়েলফুডের শোরুম : নগরীর কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজারের সাবস্টেশনের জায়গায় দোকান বরাদ্দ দিয়ে ওয়েলফুডের শোরুম স্থাপন করেছিলেন আবদুচ ছালাম। তিনি ওয়েলফুডের প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৭ সালে পুরোনো বাজার সরিয়ে কাজীর দেউড়ি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স ও কাঁচাবাজার নির্মাণের পর আবদুচ ছালাম, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিন ও বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে দুদকে অভিযোগ দেন কাজীর দেউড়ি কাঁচাবাজারের ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। এতে দোকান বরাদ্দের নামে লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, চুক্তির তোয়াক্কা না করে টাকার বিনিময়ে এলোমেলো দোকান বরাদ্দসহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিযোগের তদন্তও আলোর মুখ দেখেনি। সরকার পতনের পর থেকে আবদুচ ছালাম লাপাত্তা হওয়ায় এসব অভিযোগের বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তার মোবাইল ফোনও বন্ধ রয়েছে।