বছরে প্রেমপত্র আসে না একটিও, মাসে তালাকের চিঠি আসে ২০টি!
মো. রইছ উদ্দিন, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৮ পিএম
গীতিকার মনিরুজ্জামান মনিরের কথায় আলম খানের সুরে শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে এক সময়ের তরুণ-তরুণীদের কণ্ঠেও জনপ্রিয় ছিল- ‘চিঠি কেন আসে না, আর দেরি সহে না, ভুলেছ কি তুমি আমাকে-ভুলেছ কি নাম ঠিকানা? হ্যাঁ; তরুণ-তরুণীরা শুধু গান নয়, চিঠির বক্সের কথাও ভুলে গেছে।
এমনটাই দেখা মিলল ময়মনসিংহের গৌরীপুরে। পোস্ট অফিসের সামনে রক্ষিত পোস্ট বক্সে এক বছরেও কেউ চিঠি রাখেনি। এ বছরে প্রেমিক-প্রেমিকাদের একটি চিঠিও আসেনি এ ডাকঘরে! তবে প্রতি মাসে মিলছে প্রায় ২০টি তালাকের চিঠি!
বুধবার বিশ্ব ডাক দিবস। উপজেলার ১৪টি পোস্ট অফিসে আধুনিক গ্রাহকসেবা দেওয়ার নামে ‘ডিজিটাল পোস্ট অফিস’ কার্যক্রম অচল হয়ে পড়েছে। প্রত্যেকটি ডাকঘরে ৩টি ল্যাপটপ, স্ক্যানার মেশিন, প্রিন্টার্স, ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সুবিধার জন্য আইপিএস, আধুনিক সরঞ্জামসহ প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হয়।
বোকাইনগর ইউনিয়নের ভবানীপুর ডাকঘরের পোস্টমাস্টার (ইডিএ) মহসিন মাহমুদ শাহ জানান, এক বছরের মধ্যেই এসব যন্ত্রাংশ বিকল (নষ্ট) হয়ে গেছে। সরকারি বিভাগে চাকরি করি, আমাদের বলা হয় অবিভাগীয় কর্মচারী। যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে যাতায়াত খরচও হচ্ছে না।
তিনি আরও জানান, এখন বছরে একটাও প্রেমিক-প্রেমিকার চিঠি আসে না, পোস্টম্যানদেরও সেই রকম কদর নেই। অথচ প্রতি মাসে ২০-২৫টি করে তালাকনামার চিঠি আসে!
এ প্রসঙ্গে গৌরীপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক আহসানুল হক বলেন, ইন্টারনেটের কারণে মোবাইলে মেসেজ, খুদেবার্তা, অডিও-ভিডিওতে ঝুঁকে গেছে আজকের প্রজন্ম বা তরুণ-তরুণীরা। এটা অত্যন্ত সহজ মাধ্যম। অনেকে পোস্ট অফিসও চিনে না। তবে একটি চিঠির যে গুরুত্ব, মমতা-হৃদ্যতা ছিল-আজকের খুদেবার্তায় সেটা নেই।
তিনি আরও বলেন, বিবাহ-বিচ্ছেদের জন্য প্রধানত কারণ এখন অনলাইন সহজলভ্য হওয়ায় পরকীয়া বাড়ছে। এছাড়াও সমাজে বাল্যবিয়ে-যৌতুক নির্যাতনসহ নানা কারণ রয়েছে।
এদিকে জরাজীর্ণ ভবনে চলছে উপজেলার প্রধান ডাকঘরের কার্যক্রম। ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে, দরজা-জানালাও ভাঙা। জনবল সংকটের কারণে সেবা কার্যক্রমের গ্রাহকদের বাড়ছে ভোগান্তি।
এ উপজেলায় প্রধান ডাকঘর ছাড়াও ১০টি ইউনিয়নে রয়েছে আরও ১৪টি ডাকঘর। ইউনিয়ন পর্যায়ে অবস্থিত সিংহভাগ ডাকঘরগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে নির্ধারিত সময়ে ডাক কার্যক্রম না করার নানা অভিযোগ। প্রত্যেকটি ইউনিয়ন ডাকঘরে প্রতি মাসে ৪ হাজার ৪৮৫ টাকা পারিশ্রমিকে একজন পোস্টমাস্টার, ৪ হাজার ১৭১ টাকা পারিশ্রমিকে পোস্টম্যান ও ৪ হাজার টাকা পারিশ্রমিকে রয়েছেন ১ জন রানার।
পোস্ট অফিসগুলো হলো- রামগোপালপুর, ভবানীপুর, ডৌহাখলা, সাখুয়া মাঝেরচর, শাহগঞ্জ, গিধাউষা, মাওহা, কিল্লাতাজপুর, ভূটিয়ারকোনা, বীরআমুদপুর, পাছারবাজার, লামাপাড়া, রেলওয়ে আরএস ও মুখুরিয়ায় পোস্ট অফিস রয়েছে।
প্রধান ডাকঘরের ছাদের পলেস্তারা উঠে গেছে ও ছাদ চুয়ে ভিতরে পানি পড়ে মূল্যবান কাগজপত্র নষ্ট হচ্ছে বলে স্বীকার করেন উপজেলা পোস্টমাস্টার বাবুল চন্দ্র দাস। তিনি জানান, ভবনের কারণে আমরাও চরম দুর্ভোগে আছি।
তিনি আরও জানান, এ পোস্ট অফিসে ৩ জন রানারের মধ্যে ১ জনের পদ শূন্য, অপারেটর ৩ জনের পদ শূন্য, একটি শাখা পোস্টমাস্টার, ২ জন বিলিংম্যান ও পোস্টম্যান ১ জনের পদ শূন্য রয়েছে।
তিনি জানান, ডাক বিভাগকে ডিজিটাল পোস্ট অফিসে পরিণত করার জন্য প্রত্যেকটি পোস্ট অফিসে একজন করে উদ্যোক্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কাঙ্ক্ষিত আয় না হওয়ায় সব ডাকঘরের উদ্যোক্তারা চলে গেছেন। এ খাতে দেওয়া কম্পিউটার ও ডিজিটাল মেশিনের নানা যন্ত্রাংশ বর্তমানে বিকল অবস্থায় পড়ে আছে।
উপজেলা পোস্ট অফিসের উদ্যোক্তা মো. বাবুল মিয়া জানান, ১৪ অক্টোবর থেকে চালু হতে যাচ্ছে ‘স্মার্ট সার্ভিস সেন্টার।’ এ সেন্টারের মাধ্যমে ভিসা, পাসপোর্ট, ওয়ারিশান সনদ, জমি সংক্রান্ত, শিক্ষার্থী ও হজযাত্রীদের পাক-নিবন্ধনসহ ৮৬টি বিষয়ে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করা হবে।