পাহাড়ে কঠিন চীবর দানোৎসব না করার ঘোষণা
রাঙামাটি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫৯ পিএম
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান অস্থিরতায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে এ বছর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দানোৎসব না করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজের পক্ষে ভিক্ষুসংঘের এক যৌথ বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে রোববার দুপুরে রাঙামাটি শহরের মৈত্রী বিহারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন পার্বত্য ভিক্ষুসংঘ বাংলাদেশের সভাপতি শ্রদ্ধালংকার মহাথের। এ সময় অন্য বৌদ্ধভিক্ষুরা উপস্থিত ছিলেন।
আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু হবে। চলবে মাসজুড়ে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের এ কঠিন চীবর দানোৎসব না করার ঘোষণায় বৌদ্ধভিক্ষুদের যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে- ১৮ সেপ্টেম্বর এক ব্যক্তি মোটরসাইকেল চুরি করতে গিয়ে জনতার হাতে ধরা পড়লে গণপিটুনির শিকার হন। এ সময় পালাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার মৃত্যু ঘটে বলে খাগরাছডি সদর থানার ওসির এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে আসে।
পরে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯ সেপ্টেম্বর দীঘিনালা ও খাগডাছড়ি সদরে সাম্প্রদায়িক হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। এদিন রাতে নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে ধনরঞ্জন চাকমা, জুনান চাকমা ও রুবেল ত্রিপুরা নিহত এবং অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। শতাধিক দোকানপাট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
ওই ঘটনার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে রাঙামাটি শহরে মিছিল করা হয়। ওই মিছিলের ওপর সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে তাদের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে তা আবার সহিংস হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ঘটনায় রূপ নিয়ে পুরো রাঙামাটি শহরে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
দুর্বৃত্তরা রাঙামাটির পাহাড়ি আদিবাসীদের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, দোকানপাট ও ঘরবাড়িতে লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এমনকি রাঙামাটি ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তা বাহিনীর চৌকির আনুমানিক ১০০ গজ দূরত্বে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয়ে হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে বিপুল পরিমাণ সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের পাশাপাশি রাঙামাটি সদরের ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মৈত্রী বিহারেও ব্যাপক হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুরের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়।
এছাড়া শহরের তবলছড়ি আনন্দ বিহারেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে পবিত্র বৌদ্ধমূর্তির ওপর আঘাত করা হয়। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনায় অনিক কুমার চাকমা (১৮) নামে এক কলেজছাত্রকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয়দের অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতেই এসব হামলা, লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসন্ত্রাস চালানো হয়েছে। তাই কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তা স্থানীয় প্রশাসনের জানা থাকার কথা। কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ যাবত পার্বত্য অঞ্চলে যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটারই সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হয়নি। কখনো কখনো সরকার লোক দেখানো তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বটে কিন্তু এ যাবত কোনো তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আলোরমুখ পর্যন্ত দেখেনি । এ ধরনের লোক দেখানো তদন্ত কমিটি করে ঘটনাগুলোকে বারবার ধামাচাপা দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় পাহাড়ে চলমান সহিংসতা এবং সহিংসতা থামানোর লক্ষ্যে প্রশাসনের তরফ থেকে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ না দেখায় এবং আইনশৃঙ্খলার চরম অব্যবস্থাপনা ও অবনতি দেখে আমরা সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধসমাজ ও ভিক্ষুসংঘ বর্তমানে খুবই উদ্বিগ্ন ও শঙ্কিত। যার কারণে আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রশাসনের ওপর আস্থাহীনতা বোধ করছি। এ রকম চরম অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ সমাজ ও ভিক্ষু সংঘ আসন্ন পবিত্র ধর্মীয় উৎসব কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারে কোনো উৎসাহ বোধ করছে না। তাই এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে আসন্ন কঠিন চীবর দানোৎসব না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
যৌথ বিবৃতিতে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘ বাংলাদেশ সভাপতি ছাড়াও স্বাক্ষর করেছেন- বনভান্তের শিষ্য সংঘের সহ-সভাপতি সৌরজগৎ মহাথের, পার্বত্য ভিক্ষু পরিষদ বান্দরবানের সাধারণ সম্পাদক তেজপ্রিয় মহাথের, কাপ্তাই চিংম্রং রাজমিকায় মার্গ সহ-সভাপতি জ্ঞানবংশ মহাথের, ত্রিরত্ন ভিক্ষু অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি আয়াশী মহাথের, খাগড়াছড়ি শাসনা রক্ষিতা ভিক্ষু সংঘের সভাপতি সুমনা মহাথের, বৌদ্ধ শাসনা ভিক্ষুকল্যাণ পরিষদের সভাপতি সুরিয়েন্টা মহাথের, খাগড়াছড়ি ভিক্ষু অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আগাসারা থের, মং সার্কেল সংরক্ষিতা ভিক্ষু সংঘের সভাপতি কেসারা মহাথের, খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি ভিক্ষু সংঘের সভাপতি উত্তমা মহাথের, ওয়াল্ড পিচ ভিক্ষু সংঘের সভাপতি সুমনা মহাথের, খাগড়াছড়ির গুইমারা সংঘরাজ ওয়েনা মহাথের ভিক্ষু সংঘের সভাপতি ওইমালা মহাথের, খাগড়াছড়ির রামগড় ভিক্ষু সংঘের সভাপতি কেসারা মহাথের, বাংলাদেশ মার্মা ভিক্ষুকল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নাইন্দাওয়াংসা মহাথের ও পার্বত্য ইয়ং ভিক্ষু অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি নন্দিয়া ভিক্ষু।