Logo
Logo
×

সারাদেশ

নিজাম হাজারীকে সন্তুষ্ট করে ফেনী পৌরসভার ২৮৮ কোটি টাকা লুট

Icon

যতন মজুমদার, ফেনী

প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২২ পিএম

নিজাম হাজারীকে সন্তুষ্ট করে ফেনী পৌরসভার ২৮৮ কোটি টাকা লুট

মহাজোট সরকারের ১৫ বছর ফেনী পৌরসভা লুটপাটে রামরাজত্ব চালিয়েছেন ৬ সিন্ডিকেট সদস্য। এতে লুটে নিয়েছে শত কোটি টাকা। বিগত সময়ে ফেনী পৌরসভার কনজারভেন্সি শাখা থেকে লুট হয়েছে ২৮৮ কোটি টাকা। এসব লুটে সহযোগিতার জন্য এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং তাকে সন্তুষ্ট করেন তারা।

গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর ফেনী পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) গোলাম মো. বাতেন আগস্ট ২০২৪ মাসে কনজারভেন্সি শাখার কর্মচারীদের বেতন বিল বাবদ পরিশোধ করেছেন ১৯ লাখ টাকা। অথচ গত ১৫ বছর এ শাখা থেকে প্রতি মাসে বেতন বিল বাবদ খরচ দেখানো হতো ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা। দুই ঈদে অতিরিক্ত ৬৬ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিতেন। প্রতি মাসে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে উত্তোলন করা হতো ১৬ লাখ টাকা। বছরে টাকার পরিমাণ ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা।

এ বিষয়ে পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আবুজর গিফরী যুগান্তরকে বলেন, বিল পরিষদের বিষয়টি সত্য তবে তা কাদের দেওয়া হতো তা তিনি জানেন না। এ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডাক্তার কৃষ্ণপদ সাহা তা ভালো বলে পারবেন।

পৌর প্রশাসকের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক (উপসচিব) গোলাম মো. বাতেন যুগান্তরকে বলেন, ভয়াবহ বন্যার পর শহর পরিচ্ছন্নতার কাজ শেষ করতে আমার মাধ্যমে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ টাকা; কিন্তু অতীতে ব্যয় হতো প্রায় ৩৫ লাখ টাকা। পরিচ্ছন্ন কর্মীদের বেতন দেওয়া হতো নগদে। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো তাদের বেতন নগদে দিয়েছি। অক্টোবর থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে বেতন পরিশোধ করা হবে। চাকরি হারানো ভয়ে পরিচ্ছন্ন কর্মীরা কাজে কোনো ফাঁকি দেয়নি। তাই অল্প খরচে কাজ শেষে করতে পেরেছি।

এসব সিন্ডিকেট সদস্যরা তাদের দুর্নীতি রামরাজত্ব কায়েম করতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বারবার ভোটবিহীন ভোটে নির্বাচিত সাবেক এমপি নিজাম উদ্দিন হাজারীর সঙ্গে সখ্য ও তাকে সন্তুষ্টি পুঁজি হিসেবে খাটিয়েছে। এদের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন- পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আবুজর গিফরী, নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক, উপসহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সুমন, বিদ্যুৎ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. হিরণ মিয়া, নক্সাকার বোরহান উদ্দিন রাব্বানি ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরাফত উল্যা চৌধুরী।

২০০৯ সালে ফেনী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করে ২০২৪ পর্যন্ত ১৫ বছর এ কর্মস্থলে থেকে বর্তমানে মো. আজিজুল হক এখন নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এমপি নিজাম হাজারীকে মামা-ভাগিনা পরিচয় দিয়ে মেয়রসহ সবাইকে শাসিয়ে যেতেন। এতে তার অপকর্মের বিষয়ে কেই কথা বলতে পারত না। ইতোমধ্যে তাকে কয়েকবার বিভিন্ন পৌরসভার বদলি করা হলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অদৃশ্য খুঁটির জোরে তিনি ফেনীতেই রয়ে গেছেন।

তাদের এ অপকর্ম অব্যাহত রাখতে পৌর অর্থায়নে সাবেক এমপি নিজামের হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত তার মালিকীয় গ্রিন হাউজ, ৬টি বাড়ি ও ৫টি পুকুরঘাটে আলোকসজ্জা, ড্রেনেজ নির্মাণ ও পারিবারিক কবরস্থানকে সুসজ্জিত করে রাখতেন। প্রতি অর্থবছরে এর পেছনে পৌরসভার ব্যয় হতো প্রায় কোটি টাকা।

পৌরসভার বিধিমালার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে পৌরসভার রাজস্বের টাকা বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১৫টি বহুতল ভবন তৈরি, হাটবাজার স্কুল কলেজের গেট নির্মাণ, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ফেনী মডেল থানার উন্নয়ন ও দুই পাশে দুইটি দৃষ্টিনন্দন গেট নির্মাণ, জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ডিএসবির সাবেক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ও পুলিশ কর্তাদের ব্যক্তিগত বাসার উন্নয়নসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করেছেন। এই সিন্ডিকেটের অপকর্ম নিয়ে তৎকালীন মেয়র, কাউন্সিলর বা কোনো কর্মচারী প্রতিবাদের সাহস করতেন না। প্রতিবাদ করতে চাইলে এমপি নিজামকে দিয়ে তাদের শাসানো হতো।

এই সিন্ডিকেটকে পুঁজি করে পৌরসভা বিদ্যুৎ মালামাল ক্রয়, বিক্রি ব্যাপক দুর্নীতি আশ্রয় নেওয়া হতো। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা ছিল না। বাজার থেকে নিম্নমানের মালামাল ক্রয় করে নিজেদের ইচ্ছামতো টেন্ডার কোটেশান বানিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিত। এই সব নিম্নমানের মালামালের বিরুদ্ধে পৌরসভার বিদ্যুৎ বিভাগের শ্রমিকদের মাঝে অসন্তোষ প্রকাশ পেয়েছে গত জুলাই মাসে।

এদিকে ২০১৮ সালে ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্রের রাজাজীর দীঘির চতুর দিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণের জন্য প্রায় ৭ কোটি টাকার দরপত্র আহবান করা হয়। এতে ঠিকাদার হিসেবে নির্বাচিত করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ব্যাংকার সেন্টুকে। কিন্তু বিভিন্ন বিভিন্ন অজুহাতে দীঘির দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ কাজ করে পুরো টাকার বিল উত্তোলন করে নেয় প্রকৌশল বিভাগ; কিন্তু সরেজমিন গিয়ে দেখা যায় দীঘিটির অন্য দুই পাশে নির্মাণ কাজের কোনো অস্তিত্ব নেই।

তৎকালীন মেয়র নজরুল ইসলাম স্বপন মিয়াজির উপস্থিতে বিদ্যুৎ বিভাগের এক জরুরি সভায় শ্রমিকেরা প্রকৌশলী হিরণের বিরুদ্ধে নিম্নমানের মালামাল ক্রয়ের অভিযোগ তুলে বক্তব্য রাখেন। অভিযোগটি তদন্তের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানি (এসকিউ ওয়্যার ক্যাবেলস কোম্পানি লি.) মার্কেটিং ম্যানেজার মোহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে তলব করা হয়।

জানা যায়, ইঞ্জিনিয়ার হিরণ ওই কোম্পানির মার্কেটিং প্রতিনিধিকে মেয়রের মুখোমুখি হতে দেয়নি।

এ বিষয়ে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যুগান্তরকে জানান, দীর্ঘ সময় থেকে আমাদের কোম্পানির কোনো মালামাল ফেনী পৌরসভা ক্রয় করেননি। ব্যবহারকৃত মালামালে জালিয়াতির মাধ্যমে আমাদের কোম্পানির মনোগ্রাম ব্যবহার করেছে ইঞ্জিনিয়ার হিরণ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকৌশলী বিভাগের কয়েক কর্মকর্তা ও ঠিকাদার বলেন, ফেনী পৌরসভার সব উন্নয়ন কাজ শেষে পৌর পরিষদে অনুমোদন করা হতো। এ কৌশলকে পুঁজি করে উপসহকারী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন সুমন সব কাজে ৫০-৮০% অতিরিক্ত টাকা ধরে বিল প্রস্তুত করতেন। ঠিকাদারদের কাছ থেকে এ টাকা সুমন আদায় করে নিতে। এতে অল্প সময়ের মধ্যে সুমন শহরের উকিলপাড়ায় কোটি টাকা জমি ক্রয় করে প্রস্তুত করেছেন আধুনিকমানের ৬ তলা বাড়ি, গ্রামে বাগান বাড়ি এবং শত একর জমির মালিক বনে গেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মচারী জানান, আমাদের কোনো প্রতিবাদ কাজে আসত না। হিরণ সাবেক এমপির বাড়ির সব প্রকার বৈদ্যুতিক কাজ ও মালামাল পৌরসভার টাকায় ক্রয় করে সরবরাহ করতেন বলে হিরণ ছিল এমপির খুবেই আস্থাভাজন।

এদিকে অভিযোগ রয়েছে, ফেনী পৌরসভা নক্সাকার বোরহান উদ্দিন রাব্বানিকে ২০১৪ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় ১ম স্থান অধিকারী কামরুল ইসলামের খাতা টেম্পারিং করে অবৈধভাবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরাফত উদ্দিন চৌধুরী ও তৎকালীন সচিব শাহাজান মজুমদার তাকে নিয়োগ দেন। এর মধ্যে সৈয়দ মো. আবুজর গিফরী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরাফত উদ্দিনকে টাকা দিয়ে দুইবার পদোন্নতি নিয়েছেন বোরহান। পদোন্নতিকে কাজে লাগিয়ে পৌরসভার বাড়ির মালিকদের নক্সার বহির্ভূত বাড়ি করার অভিযোগ তোলে। পাড়ায়-মহল্লার মালিকদের নোটিশ করে বাড়ি ভাঙার ভয় দেখিয়ে প্রায় ১৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার এ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে সমর্থন জোগাতে কয়েক কর্মকর্তাকে হজ পালন করিয়েছেন এবং বোরহান ফেনী শহরের নাজির রোড ও গ্রামে কোটি টাকার জমি ও গাড়ি ক্রয় করেছেন বোরহান উদ্দিন। আর এসব ক্রয়ের দুর্নীতির টাকা ভাগ পেতেন উক্ত কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক যুগান্তরকে বলেন, সাবেক এমপি নিজাম হাজারীকে সন্তুষ্ট রাখতে অনেকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিত। পৌরসভা থেকে সাবেক এমপি নিজাম হাজারী সব বৈদ্যুতিক মালামাল ও শ্রমিক সরবরাহ করত। এ বিষয়ে কারও প্রতিবাদ করা সাহস ছিল না।

নক্সাকারী বোরহান উদ্দিনের বিষয়ে প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় যে ছেলেটি প্রথম হয়েছিল কামরুল। তাকে বাদ দিয়ে তৎকালীন শাহাজান মজুমদার ও শরাফত উদ্দিন চৌধুরী ২ লাখ টাকার বিনিময়ে বোরহান উদ্দিনকে নিয়োগ দিয়েছেন। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বোরহানের অপকর্ম কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ২০২১ সালে বাড়ির মালিকদের অনুমোদিত নক্সার বাহিরে ঘর করার অভিযোগ তুলে বোরহান উদ্দিন ১৩ কোটি টাকা হাতিয়েছে। ওই টাকা বোরহান ও কতিপয় কর্মকর্তা ভাগ-বণ্টন করে নিয়েছেন।

বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলী হিরণ বলেন, আমাদের কিছু করার ছিল না। সবাই তৎকালীন এমপির বন্দনায় মগ্ন ছিলেন। আমি যা করেছি চাকরি রক্ষার্থে করেছি।

মালামাল ক্রয়ের অনিয়মের বিষয়ে হিরণ যুগান্তরকে জানান, পৌর কর্তৃপক্ষ শামীম এন্টারপ্রাইজ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এসকিউ ওয়্যার ক্যাবলস কোম্পানির মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ দিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠান মালামাল সরবরাহ করেছে।

কর্মচারীদের অভিযোগ বিষয়ে বলেন, মালামালের গুণগতমান ছিল না তথ্যটি সঠিক। আমারও কিছু করার ছিল না। বিদ্যুৎ শ্রমিক সুবিধা পায়নি বলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেছে। 

নক্সাকার বোরহান উদ্দিন রাব্বানি বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ মিথ্যা। আমাকে কিভাবে নিয়োগ দিয়েছে তা তৎকালীন মেয়র জানেন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তা শরাফত উল্যা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, আমি কোনো অপকর্মের সঙ্গে জড়িত নই।

শামীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. শামীম আরাফাত জানান, ফেনী পৌরসভার কাছে ৪৫ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। আমাকে যখন যে মাল চেয়েছে আমি সেই মাল দিয়েছি। ইঞ্জিনিয়ার হিরণ বাহিরে কোনো অনিয়ম করেছেন কিনা সেটা জানা নেই।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম