যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ
ছাত্রলীগের হাতে জিম্মি ছিল ক্যাম্পাস, চলত নির্যাতন
যশোর ব্যুরো
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৬ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
যশোরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার ও সাবেক এমপি নাবিল আহমেদ গ্রুপের দা-কুমড়া সম্পর্ক ছিল। শহরের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া ছিল দুই গ্রুপই। তাদের আধিপত্যের লড়াইয়ে বড় হাতিয়ার ছিল নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এই ক্যাডার বাহিনীর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল সরকারি মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজের দুটি ছাত্রাবাস। যা দুই গ্রুপের কাছেই ‘পাওয়ার হাউজ’ হিসাবে পরিচিত ছিল। এই ছাত্রাবাস দুটি যে গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকত, তাদের মিটিং, মিছিল ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা সহজ ছিল। এজন্য দখল-পালটাদখলের মধ্য দিয়েই দুই গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত ছাত্রাবাস দুটি। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পরিবর্তে অছাত্র ও সন্ত্রাসী ক্যাডার বাহিনীর ‘অভয়াশ্রম’ হয়ে ওঠে দুটি ছাত্রাবাস। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের জিম্মি থেকে মুক্ত হয়েছে ছাত্রাবাস দুটি। এখন বেরিয়ে আসছে তাদের ছাত্রাবাস ও ক্যাম্পাসের নোংরা রাজনীতির চিত্র।
দক্ষিণবঙ্গের বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে ১৯টি বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর, উচ্চ মাধ্যমিক, ডিগ্রি পাস কোর্স চালু রয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করেন। তাদের আবাসনের জন্য চারটি ছাত্রাবাস রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রদের জন্য শহিদ আসাদ হলে ১২০টি ও শহরের চুয়াডাঙ্গা স্ট্যান্ডে অবস্থিত শেখ কামাল হল বা পুরাতন ছাত্রাবাসে ১৩৫টি আসন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রাবাস দুটি দখলে রাখতেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার ও যশোর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারীরা। তাদের দলীয় মিছিল-মিটিংয়ে না গেলে সিট মিলত না। ছাত্রাবাস দুটি ছিল ছাত্রলীগের ‘টর্চার সেল’। এখানে আটকে রেখে শিক্ষার্থী নির্যাতন, মাদক বিক্রি, হুমকি, ভয়ভীতি, চাঁদাবাজি করা হতো। দুটি ছাত্রাবাসের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো ক্যাম্পাস। তাদের ইশারায় চলত কলেজ প্রশাসনও।
সর্বশেষ শেখ কামাল হলটি দখলে ছিল সাবেক এমপি কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারী পৌর কাউন্সিলর শেখ জাহিদ হোসেন মিলন ওরফে টাক মিলনের। তার ক্যাডার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণেই হলটি পরিচালিত হতো। হলে ছাত্রলীগ, বহিরাগতদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। এখান থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা হতো শহরের মেসগুলোও। ফলে তাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ না নিলে নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের প্রায় এক মাস আগে শহিদ আসাদ হল নিয়ন্ত্রণে নেন শাহীন চাকলাদারের অনুসারীরা। যদিও এর আগে হলটির নিয়ন্ত্রণ ছিল কাজী নাবিল আহমেদের অনুসারীদের। এক দশক ধরে আওয়ামী লীগের দুটি গ্রুপ হল দুটি দখল-পালটা দখলে রেখেছিলেন।
এদিকে কলেজের চারটি পুকুরে ২০১১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বিপুল, সাবেক সভাপতি রওশন ইকবাল শাহী ও তার অনুসারী ইজারা ছাড়াই মাছ চাষ করেছেন। ২০২৩ সাল থেকে পুকুর চারটি নিয়ন্ত্রণে নেন যশোর পৌরসভার কাউন্সিলর শেখ জাহিদ হোসেন মিলন। এক দশক ধরে বিনা ইজারায় মাছ চাষ করায় কলেজ কর্তৃপক্ষ বিপুল পরিমাণ অর্থ রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আনোয়ার হোসেন বলেন, চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী এসে ছাত্রদলের সভাপতির সঙ্গে তার তোলা একটি ছবি দেখায়। এরপর ‘ছাত্রদল করিস’ এই অভিযোগ তুলে কমনরুমে নিয়ে তাকে বেধড়ক মারধর করে। ক্রিকেট খেলার স্টাম্প ও পুরনো বেঞ্চের পায়া দিয়ে দরজা বন্ধ করে পেটায়।
যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির বলেন, ৫ আগস্টের আগে একটি ছাত্র সংগঠন বিশৃঙ্খলামূলক অনেক কাজ করেছে। এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। ক্যাম্পাসে শৃঙ্খলা ফেরাতে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে সভা করেছি। ছাত্রাবাসগুলো সাধারণ শিক্ষার্থীদের করতে সব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক আবেদন পড়েছে, যাচাই-বাছাই করে অনেক শিক্ষার্থীকে উঠানো হয়েছে।