স্বাভাবিক হচ্ছে রাঙামাটি, জনমনে স্বস্তি
সুশীল প্রসাদ চাকমা, রাঙামাটি
প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৫ পিএম
রাঙামাটিতে পাহাড়ি বাঙালি সহিংস ঘটনার তিন দিন পর সার্বিক পরিস্থিতি এখন উন্নতির পথে। ফিরতে শুরু করেছে স্বাভাবিক পরিবেশ। জনমনে ফিরছে স্বস্তি। শুরু হয়েছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। সোমবার সকাল থেকে শহরে দোকানপাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে। বসছে হাটবাজার। প্রশাসনের আশ্বাসে এদিন সকাল থেকে অটোরিকশাসহ অভ্যন্তরীণ যানবাহন চলাচল করছে।
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম এবং রাঙামাটি-বান্দরবান রুটেও সড়ক পথে যানবাহন চলাচল করছে। তবে জুম্ম ছাত্র-জনতার ডাকা শনিবার সকাল থেকে ৭২ ঘণ্টার সড়ক ও নৌ অবরোধের কারণে রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কে যানবাহন এবং রাঙামাটির নৌ রুটে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে রাঙামাটি শহরসহ আশপাশের এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরাপত্তা জোরদার রয়েছে। প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলের উদ্যোগে সহিংসতাবিরোধী তৎপরতায় শান্তি-সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এতে পাহাড়ি বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে পারস্পরিক আস্থা-বিশ্বাস ও সহাবস্থান অটুট করার তৎপরতা চলছে। সোমবার সকালে শহরের বনরুপা, হ্যাপিরমোড়, কাঠালতলীসহ বিভিন্ন এলাকায় জনগণের সঙ্গে মৈত্রীবন্ধন কর্মসূচি পালন করে জেলা বিএনপি।
এ সময় জেলা বিএনপির সভাপতি দীপন তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশিদ, যুগ্ম সম্পাদক আলী বাবরসহ জেলা ও পৌর বিএনপি নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
রাঙামাটিতে সংঘর্ষে নিহতের ঘটনায় মামলা হয়েছে। শনিবার রাতে রাঙামাটির কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেছেন নিহত কলেজছাত্র অনিক কুমার চাকমার বাবা আদর সেন চাকমা। এতে অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। অনিক চাকমার লাশ ঘটনার পরদিন শনিবার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কাউকে এখনো গ্রেফতার নেই।
তবে অনিককে পেটানোর একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখানে কয়েকজনের চেহারা দেখে পরিচয় স্পষ্ট হয়। ঘটনার সময় ২০ সেপ্টেম্বর রাঙামাটি শহরের কালিন্দীপুর এলাকায় অনিক চাকমাকে রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ হত্যাকাণ্ডসহ রাঙামাটির সহিংসতার ঘটনায় এ পর্যন্ত দুটি মামলা হয়েছে।
আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার এসএম ফরহাদ হোসেন। তিনি বলেন, দোষী কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনের আওতায় এনে আসামিদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।
অন্যদিকে ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটরসাইকেল চোর সন্দেহে যে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, সেই মো. মামুন হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাসহ তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয়ের ১০-১২ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। হত্যার পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে নিহত মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি করেন বলে জানান খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি আবদুল বাতেন মৃধা।
মামলার আসামিরা হলেন- খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দিদারুল আলম, খাগড়াছড়ির সাবেক পৌর মেয়র মো. রফিকুল আলম এবং স্থানীয় মো. শাকিলসহ অজ্ঞাত পরিচিতরা।
রাঙামাটিতে ২০ সেপ্টেম্বরের সহিংসতার পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সম্প্রীতির পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, স্বরাষ্ট্র এবং পার্বত্য মন্ত্রণালয়সহ চার উপদেষ্টা রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি সফর করে যান। এছাড়া রোববার রাঙামাটিতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সম্প্রীতি সমাবেশ করা হয়। ফলে ধীরে ধীরে পাহাড়ি বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের মাঝে জনমনে পারস্পরিক আতঙ্ক কেটে আস্থা ও বিশ্বাস ফিরতে শুরু করে।
এদিকে রাঙামাটি শহরে সহিংসতা ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবহণগুলোর ক্ষতিপূরণসহ পরিবহণ শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবিতে অনির্দিষ্টকালের ডাকা ধর্মঘটে শুক্রবার থেকে সব ধরনের অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার সড়ক পরিবহণ চলাচল বন্ধ থাকে। সংশ্লিষ্ট সব সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ এ ধর্মঘট ডাকে। রোববার সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসে প্রশাসন এসব দাবি নিয়ে আশ্বাস দিলে সোমবার সকাল থেকে সব ধরনের যানবাহন চলাচল শুরু করে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা।
এ সময় জেলা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি পরেশ মজুমদার, সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাবু, অটোরিকশা মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী বাবর, ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহিম আকাশ, মিনিট্রাক পিকআপ মালিক সমিতির আহবায়ক অলোক প্রিয় চৌধুরী রিন্টু, ট্রাক, মিনিট্রাক পিকআপ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এটিএম হাসমত উল্লাহ, মাইক্রোবাস চালক-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক কামাল হোসেন, মোটরবাস মালিক সমিতির সমন্বয়ক সালাউদ্দিনসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) সহ-সভাপতি নতুন কুমার চাকমা জানান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে পাহাড়িদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, খুন ও বিহার-ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনার প্রতিবাদে ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার আয়োজিত সমাবেশ থেকে ঘোষিত তিন পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) ৭২ ঘণ্টা সড়ক ও নৌপথ অবরোধ কর্মসূচির প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে এ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।
এদিকে রাঙামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সহিংসতায় হতাহত, অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরের ঘটনায় একটি সমন্বয় কমিটি করে পুরো ঘটনার তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. মোশারফ হোসেন খান। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও স্থাপনা সরেজমিন পরিদর্শনসহ সোমবার সকালে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। এতে প্রাথমিক জরিপে ক্ষতির পরিমাণ ১০-১২ কোটি টাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এ ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত উল্লেখ করে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।