প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ পিএম
লক্ষ্মীপুরের রামগতির বিবিরহাট রশিদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তারের বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
চতুর্থ শ্রেণির তিন কর্মচারীকে দিয়ে বাড়ির কাজ করানো, ঢাকার বনশ্রীতে তার বাসায় নিয়ে কাজ করতে বাধ্য করা, কথায় কথায় তুচ্ছ ব্যবহার, হাজিরা খাতা ড্রয়ারে আটকে রেখে খাতায় সই দিতে না দেওয়া, ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে মারধর করা, মিথ্যা তথ্য দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ, বিভিন্ন সময়ে চাকরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়সহ নানান অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তারের এসব অনিয়ম, দুর্নীতি, ও শারীরিক নির্যানের প্রতিকার চেয়ে ওই তিন ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি কারিমুল হককে দিয়ে প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তার তার নিজের বাসার টয়লেট পরিষ্কারসহ ঘরের সমস্ত কাজ করিয়ে নেন। এমনকি তার ঢাকার বনশ্রীর বাসায় নিয়েও গৃহস্থালী কাজ করতে বাধ্য করেন। একপর্যায়ে তার এসব কর্মকান্ডে অনিহা জানালে বিদ্যালয় থেকে নেওয়া দুই দিনের ছুটির খাতায় সভাপতির করা স্বাক্ষর (ফ্লুইড) সাদা কালি দিয়ে মুছে ১৩ দিন দেখিয়ে বেতন কর্তন করেন।
এমনকি বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার পরেও কর্মচারি হাজিরা খাতা ব্যক্তিগত ড্রয়ারে আটকে রেখে গত পহেলা আগষ্ট থেকে অদ্যবধি এক মাস ৮ দিন হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতে দিচ্ছেননা। অন্যদিকে অনুপস্থিত দেখিয়ে আগষ্ট মাসের ২৫ দিনের বেতনও কর্তন করেন।
অভিযোগে আরও জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সাধারণ ছাত্ররা স্কুলে টাঙ্গানো শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনার ছবি ভাংচুরের জন্য স্কুল ঘেরাও করলে সহকারী প্রধান শিক্ষক শাহাদাত হোসেনের নির্দেশনায় ছবি নামানো ক্ষিপ্ত হয়ে প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তার কারিমূলকে বেদম মারধর করেন। একপর্যায়ে গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা উদ্ধার করে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন।
প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তার কর্মচারী কারিমুলকে ২০২২ সালের ২২ আগস্ট নন ব্রেক অব সার্ভিস সনদ প্রদান করে সেখানে উল্লেখ করেন, সে চাকরি জীবনে বিনা বেতনে ছুটি ভোগ করেননি এবং কোনো বেতন কর্তন করা হয় নাই। অথচ ১২০ দিনের বেতন কর্তন করে নেন তিনি।
একইভাবে কর্মচারী হৃদয় মাহমুদ রাজু অভিযোগে উল্লেখ করেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রধান শিক্ষক তার দলীয় ও পছন্দের নৌকা প্রতিকের প্রার্থী মোশারেফ হোসেনের পক্ষে ভোটের সময়ে কাজ না করার কারণে গত ১ আগস্ট তারিখে তাকে বেআইনিভাবে বহিস্কার করেন। নিয়োগের সময় বেতন ৮ হাজার টাকা ধার্য করা হলেও কয়েক মাস তাকে আড়াই হাজার টাকা প্রদান করেন।
প্রধান শিক্ষক চাকরি এমপিওভুক্তি করার কথা বলে তার থেকে এক লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন। তাকে বেআইনিভাবে বহিষ্কার করার পর বকেয়া বেতন ও ঘুসের এক লাখ টাকা ফেরত চাইলে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। পরে ইউপি চেয়ারম্যান দিদারের বাড়িতে হামলার ঘটনায় ৫০নং এজাহার নামীয় আসামি হিসেবে জড়িয়ে দেন তাকে।
নৈশপ্রহরী ওয়াছেক বিল্লাহ তার অভিযোগে উল্লেখ করেন, প্রধান শিক্ষক প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে ভোট করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। ভোট না করায় তাদের উপর শারীরিক ও মানষিক নির্যাতন করেন। রাজনৈতিক সুবিধা প্রাপ্তিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদের স্ত্রীকে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তাকে অন্যায়ভাবে সাময়িক বহিষ্কার করেন ও স্থায়ী বহিষ্কারের হুমকি দেন।
তার সাজানো ৫ সদস্যর তদন্ত কমিটি মিথ্যা প্রতিবেদন দাঁড় করিয়ে ৪৯ মাসের বেতনের সরকারি ও বিদ্যালয়ের অংশ, বোনাস, বৈশাখী ভাতাসহ অন্যান্য কোন টাকা উত্তোলন করতে পারেনি। প্রধান শিক্ষক ২২/০৯/২০২২ তারিখে নন ব্রেক অব সার্ভিস সনদে উল্লেখ করেন সে নৈশ প্রহরী হিসেবে কর্মরত আছে। ওয়াছেক বিল্লার উক্ত পদের পত্রিকা বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগপত্র ও যোগদান পত্রে নৈশ প্রহরী উল্লেখ রয়েছে।
সনদে আরও উল্লেখ করেন সে বিনা বেতনে কখনো চাকরি করেননি বা বেতন কর্তন করা হয়নি কিন্তু নভেম্বর ২০১৭ থেকে নভেম্বর ২০২১ পর্যন্ত ৪৯ মাসের বেতন কর্তন করা হয়েছে। তার কাছ থেকে জুন টু জুন ব্যাংক স্ট্যাম্প ও অতিরিক্তি ব্লাঙ্ক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, সরকারি বেতন ও স্কুলের ভাতা, বোনাস, বৈশাখী ভাতাসহ বিভিন্ন খাতের প্রায় ১৫ লাখ টাকা বকেয়া পাওনা রয়েছে তাদের। যে কারণে তদের ব্যাংক লোন পরিশোধে বিঘ্ন ঘটছে।
এ বিষয়ে জানতে বিদ্যালয়ে সরেজমিন গেলে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্কুল শিক্ষক এবং কর্মচারীরা জানান, তুহিনা আক্তার ব্যক্তিগতভাবে আওয়ামী ঘরানার লোক। সরকারি নির্দেশ অমান্য করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আদেশের পরও স্কুলটি বন্ধ করে রেখে সরকার পতনে শোক দিবস পালন করছেন তিনি।
এ বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তুহিনা আক্তারের কাছে জানতে চাইলে বলেন, যা করেছি সবকিছু নিয়ম মোতাবেক করেছি। অনিয়ম, দুর্নীতি, অর্থ আত্মসাৎ, কর্মচারীদের লাঞ্ছিত করার বিষয়ে সদুত্তর না দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ দিদার হোসেন জানান, স্কুলটি খোলা থাকার কথা তবে কেন কী কারণে প্রধান শিক্ষক স্কুল খোলেননি তার খবর নিচ্ছি। গাফিলতি থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে আর্থিক কেলেংকারীর বিষয়ে কোনো সদুত্তর দেন নাই।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও বিদ্যালয়ের সভাপতি সৈয়দ আমজাদ হোসেন, প্রধান শিক্ষকের ছুটি বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি। অন্যান্য অভিযোগের বিষয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বলেন।