কিশোরগঞ্জে মূর্তিমান আতঙ্ক সুলতানের ক্যাডার বাহিনী
এ টি এম নিজাম, কিশোরগঞ্জ
প্রকাশ: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:০৯ পিএম
সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন
রাজনৈতিক প্রভাব আর সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীকে ব্যবহার করে কিশোরগঞ্জে গড়ে উঠেছিল সুলতান বাহিনীর দুর্নীতির বেপরোয়া সিন্ডিকেট। ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলা কিশোরগঞ্জ-০২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিনের ছেলে কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য এস এম তৌফিকুল হাসান সাগর ওরফে সুলতান এমন অন্যায় ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। ওই সুলতান বাহিনীর লোকজন প্রশাসনকে টেক্কা দিয়ে কিশোরগঞ্জে দোর্দণ্ড প্রতাপে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের মূর্তিমান আতঙ্ক হিসাবে আবির্ভূত হয়। ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সংসদ সদস্য বাবার ছায়াতলে বসে নিজ নির্বাচনি এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ম্যানেজিং কমিটি থেকে আরম্ভ করে।
অধুনা লুপ্ত কালিয়াচাপড়া সুগার মিলের যন্ত্রাংশ ও মালামাল পাচার, বালুমহাল, টিসিবি ডিলারশিপের মতো লাভজনক কাজগুলোর একক নিয়ন্ত্রণ লাভ করে। এমনকি সুলতান নিজেই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ দখল করে নেয়। মাত্র ৭ মাসেই এসব খাত থেকে কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় সুলতান। একই সঙ্গে তার নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জ জেলা জুড়ে গড়ে ওঠে ভারতীয় চোরাই চিনির একটি বেপরোয়া শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নদী ও সড়কপথে আমদানিকৃত এসব চোরাই চিনি কিশোরগঞ্জ রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যেত। আর ওই চিনি চোরাচালান থেকেই প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হতো সুলতান সিন্ডিকেটের। এ ছাড়া কটিয়াদী ও পাকুন্দিয়া উপজেলার ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ নদীতে ড্রেজিং বোট লাগিয়ে সুলতান বাহিনী গড়ে তোলে কোটি কোটি টাকার বালু উত্তোলনের রমরমা বাণিজ্য। জানা যায়, এই দুই উপজেলার নদ-নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন বাণিজ্য থেকেই কয়েক কোটি টাকা কামাই করে সুলতান। তার বাবা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর পরই নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে সাগর ওরফে সুলতান জানিয়ে দেন, ‘টাকা খরচ করে আমরা এমপি হয়েছি, এখন আমি সুদে-আসলে সে টাকা তুলব। এ নিয়ে যেন কারও কোনো কথা না শুনি।’
এরপরই ভয়াবহ গতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে সুলতানের টাকা কামানোর মিশন। এসব ব্যাপারে কথা বলার জন্য বুধবার দুপুরে এসএম তৌফিকুল হাসান সাগর ওরফে সুলতানের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার রিং দিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এলাকায় ওপেন সিক্রেট হিসেবে প্রচার আছে, গত ৮ মে অনুষ্ঠিত পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সমর্থনের জন্য তৎকালীন পাটুয়াভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক জুটনের কাছ থেকে সুলতান ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সুলতানকে ওই বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে সুলতানের আনুকূল্য লাভ করেন। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ১৬ এপ্রিল এমদাদুল হক জুটন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন। নির্বাচনের দিন সুলতান বাহিনী তার পক্ষে ভোটে ব্যাপক অনিয়মসহ একাধিক কেন্দ্র দখলেও ভূমিকা পালন করে। উপরন্তু ; ফলাফল ঘোষণার সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে এমদাদুল হক জুটনকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে সুলতান বাহিনীর লোকজন। এ ঘটনায় প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রার্থী নির্বাচনি ট্রাইব্যুনালে মামলা করলে ভোটভর্তি ব্যালটবাক্স আদালতের জিম্মায় রাখা হয়। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনের সময় গত ৪ আগস্ট সংসদ সদস্য সোহরাব ও তার ছেলে সাগর ওরফে সুলতানের নেতৃত্বে পাকুন্দিয়া সদরে আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালানো হয়। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর সুলতান বাহিনী উপজেলার দরগা বাজারে সোহরাবের বাসভবনকে ঘিরে শক্ত অবস্থান নেয়। সুলতান বাহিনীর পাহারায় গত ১২ই আগস্ট সেখানে একটি সভাও হয়। কিন্তু ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পিতা-পুত্র পাকুন্দিয়া ত্যাগ করেন।