Logo
Logo
×

সারাদেশ

সহকারী থেকে জেল সুপার আনোয়ারুল, দুর্নীতি-অনিয়মে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক

Icon

মুহাম্মদ আবুল কাশেম

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০১:৫৩ পিএম

সহকারী থেকে জেল সুপার আনোয়ারুল, দুর্নীতি-অনিয়মে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক

বিতর্কিত জেল সুপার আনোয়ারুল করিম

গাজীপুর জেলা কারাগারের বিতর্কিত জেল সুপার আনোয়ারুল করিমের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠার পর তাকে সম্প্রতি বদলি করা হয়। কিন্তু তিনি অবমুক্ত না হয়ে এখনও বহালতবিয়তে রয়েছেন। এতে করে কারা শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রায় দেড় বছর আগে তিনি গাজীপুরে জেল সুপার হিসাবে যোগদান করেন। এরপর থেকে কারাগার অভ্যন্তরে বিস্তর অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়মে পরিণত হয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আনোয়ারুল করিমের একক আধিপত্যে চলছে গাজীপুর জেলা কারাগারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। নিয়মের বাইরে গিয়ে বন্দিদের ওপর চালানো হয় নানা জুলুম-নির্যাতন। এর প্রতিবাদে ৮ আগস্ট বন্দিরা বিদ্রোহ করেন। তখন জেল সুপারের নির্দেশে কারারক্ষীরা বন্দিদের ওপর ফাঁকা গুলি ছোড়েন। এছাড়া তার অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে প্রতিবাদ করায় অন্তত ৪৮ জন বন্দিকে পরে কারাগারের ভেতরে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানো হয়। এতে অনেক বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে তাদের হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়। সূত্র বলছে, জেল সুপার আনোয়ারুল করিম এক সময় কারা সহকারী ছিলেন। পরে মোটা অঙ্কের ঘুস দিয়ে হয়েছেন সাব-জেলার। এর কিছুদিন পরে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে সখ্য ভালো ছিল বলে খুব দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে হয়ে যান জেল সুপার। এরপর অল্প সময়ের ব্যবধানে খুলে যায় তার ভাগ্যের চাকা। কারাগারের জেল সুপার বা জেলার হওয়া মানে সোনার হরিণ অনেকটা হাতে পাওয়ার সমান। সেই সোনার হরিণকে পদে পদে কাজে লাগাচ্ছেন জেল সুপার আনোয়ারুল করিম। অভিযোগ রয়েছে, জেল সুপার আনোয়ারুল করিম টাকার বিনিময়ে বন্দিদের সরকারি মোবাইল ফোন ব্যবহারের সুযোগ দেন। এছাড়া, ভেতরে তার সৃষ্ট বাহিনীর মাধ্যমে দৈনিক কমপক্ষে ৩০টা আনডিউ দেখা করতে দেওয়া হয়। বিনিময়ে নেওয়া হয় ২ হাজার টাকা। ওই টাকা থেকে ১ হাজার টাকা নেন জেল সুপার। বাকি ১ হাজার টাকা তার সিন্ডিকেটের অন্যরা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন। কারা মহাপরিদর্শকের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় গাজীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলা কারাগারে জেল সুপারের দায়িত্ব পান। মালিক হয়েছেন অর্ধশত কোটি টাকার। কারাগারে প্রতিটি ওয়ার্ডের বারান্দায় মনমতো সিট বানিয়ে টাকাওয়ালা বন্দির কাছে বিক্রি করা হয়। আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি নিজাম হাজারির ক্ষমতা দাপট দেখিয়ে অনেক দক্ষ অফিসারকে টপকিয়ে জেল সুপার হন আনোয়ারুল করিম। এই জেল সুপারের রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৫ তলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি।

জেল সুপারের বাণিজ্য : সদ্য মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দি যুগান্তরকে বলেন, কারাগারের ভেতরে ক্যান্টিনে রান্না করা ১টি ডিম বিক্রি করা হয় ৫৫-৬০ টাকায়। কিন্তু পিসি বইতে ডিমের পরিবর্তে দেখানো হয় আইসক্রিম বা অন্য কোনো পণ্য। যার বাজার মূল্য ২৫ টাকা। রান্না করা ১ কেজি গরুর মাংস বিক্রি করা হয় ২ হাজার ৫০০ টাকায়। কিন্তু পিসি বইতে দেখানো হয় ১ বাটি গরুর মাংস মাত্র ১২০ টাকা। এছাড়া ব্রয়লার মুরগির মাংস প্রতি কেজি ক্যান্টিনে রান্না করে বিক্রি করেন ১৫-১৮শ টাকায়। পাঙাশ রান্না করে কেজিপ্রতি বিক্রি করেন ১২০০ টাকা। এভাবে চড়া দামে বিক্রি করে বন্দিদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩০-৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন জেল সুপার আনোয়ারুল করিম।

এছাড়াও জেল সুপারের সহায়তায় কারাগারে বন্দি থাকা ৩০ জন আসামিকে অসুস্থ বানিয়ে কারা হাসপাতালে রাখা হয়েছে। শুরুতেই হাসপাতালের ভর্তি ফি নেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। পরে সেখানে নিয়মিত থাকতে চাইলে প্রতি মাসে দিতে হয় ১৫ হাজার টাকা। এ টাকা জেল সুপার ও ফার্মাসিস্ট মিলে ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন। কারাগারে বন্দিদের জন্য দৈনিক ২২০ কেজি মসুর ডাল বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু বরাদ্দের মসুর ডাল থেকে ৫০ কেজির মতো দিয়ে বাকি ডাল তারা আত্মসাৎ করেন। দৈনিক ৫০০ কেজি চাল বরাদ্দ থেকে দেওয়া হয় ৩০০ কেজি। বাকি চাল তারা বিক্রি করে দেন। এসব কিছু অনিয়মের কলকাঠি নাড়েন কারারক্ষী মো. শামসুল হুদা। জেলারও অনেকটা জেল সুপারের কাছে জিম্মি দশায় রয়েছেন। যার কারণে তিনি ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না।

জেল সুপারের অর্ডালির চাঁদাবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্য: কারারক্ষী মো. শামসুল হুদার (১৩১৪৪) আলাদা একটা গ্রুপ রয়েছে। ওই গ্রুপের কাছে জিম্মি পুরো গাজীপুর জেলা কারাগারের বন্দিরা। কারারক্ষী শামসুল হুদার অন্যতম সহযোগী কারারক্ষী মো. রফিকুল ইসলাম (১৪৭৭৭), মো. রবিউল ইসলাম (১৩৩৭৫), কারারক্ষী নং (১৪৬৬৫) মো. মমিনুল ইসলাম, কারারক্ষী নং (১২৭৯৪) মো. আহসান হাবিব, কারারক্ষী নং ১২২৬০ মো. আজিজ, কারারক্ষী নং ১৩৫০১ মো. রেজাউল করিম। এই ছয়জন কারারক্ষী দিয়ে কারাগারে ভেতরে ও বাইরের সব চাঁদা তোলা হয়। কোনো ওয়ার্ডের মেড কে হবে, রাইটার হবে কে, কোন দায়িত্বে যেতে কত টাকা দেবে, কার রেট বেশি, কোন ওয়ার্ড থেকে মাসিক কত টাকা কালেকশন হবে এগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন তারা। ঠিকমতো মাসে টাকা পরিশোধ করতে না পারলে বন্দিদের ওপর চলে অমানবিক নির্যাতন। ওই গ্রুপের সঙ্গে কোনো কারারক্ষী যোগ না দিলে মিলবে না কোনো সুযোগ-সুবিধা। কারারক্ষী শামসুল হুদা হলেন নিয়োগ বাণিজ্যর মূল হোতা। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২ কর্মরত কারারক্ষী আল আমিনের কাছ থেকে নিয়োগ দেওয়ার নাম করে শামসুল ৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কারারক্ষী শামসুল হুদা ছিলেন দুর্নীতির দায়ে চাকরিচ্যুত হওয়া সাবেক ডিআইজি প্রিজন্স মো. বজলুল রশিদের একান্ত আস্থাভাজন। তাই কারারক্ষী শামসুল হুদা যে কারাগারে যোগদান করেন সেখানে কিছু কারারক্ষী নিয়ে গড়ে তুলেন একটি নিজস্ব বাহিনী। এদের মাধ্যমে কারাগারের ভেতরে জেল সুপার আনোয়ারুল করিমের ছত্রছায়ায় মাদক সরবরাহ করা হয়। অন্য কারারক্ষীরা তাদের এসব অপকর্ম নিয়ে মুখ খুললে চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দেন শামশুল হুদা। গাজীপুর কারাগারের জেল সুপার আনোয়ারুল করিম যুগান্তরকে বলেন, আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আসছে সেগুলো সত্য নয়। পরে তিনি সংবাদ না করার শর্তে প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম