রেহাই পাননি দলের নেতাকর্মীরাও
বাড়ি গাড়ি মার্কেট ফ্ল্যাট- কী নেই ওদুদের!
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১০:৩৫ এএম
ওদুদ বিশ্বাসকে ফুল দিয়ে বরণ করছেন পরিবারের সদস্যরা। ছবি: সংগৃহীত
আওয়ামী লীগের টিকিটে ২০০৮ সালে প্রথমবার সংসদ-সদস্য হয়েই টাকা কামানোর নেশায় মত্ত হয়ে পড়েন চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস। ২০২৪ সালে চতুর্থবারের মতো সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়ে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি কামিয়েছেন টাকা। এলাকার মানুষকে কৌশলে বিপাকে ফেলে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে টাকা কামানোর কাজটি করতেন ওদুদ বিশ্বাস।
দলের নেতাকর্মীরাও তার ভয়ংকর থাবা থেকে রেহাই পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে। একাধিকবার এলাকার মানুষ তার অবৈধ সম্পদ ও কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে দুদকে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। সর্বশেষ অভিযোগ দেওয়া হয়েছিল গত বছর জুলাই মাসে। কিন্তু অনুসন্ধান কিংবা তদন্ত কোনোটাই হয়নি। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর থেকে লাপাত্তা আব্দুল ওদুদ বিশ্বাস।
এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওদুদ বিশ্বাস সর্বক্ষেত্রে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলে মত্ত ছিলেন। ফলে ২০০৮ সালে এমপি হয়ে গত ১৬ বছরে ফুলেফেঁপে ওঠেন তিনি। এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঢাকায় গড়েছেন অঢেল সম্পদ। তার এই সম্পদের আনুমানিক মূল্য শতকোটি টাকা। সবখানে জমি, মার্কেট, বাড়ির ছড়াছড়ি। সম্পদের মূল্য কম দেখিয়ে ফাঁকি দিয়েছেন আয়কর।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনি হলফনামায় তিনি যে পরিমাণ সম্পদের বিবরণ দিয়েছিলেন গত ১৬ বছরে তার সম্পদ বেড়েছে বহুগুণ। দলীয় নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে মামলার ফাঁদে ফেলে কামিয়েছেন টাকা। মাদক কারবারিসহ চিহ্নিত অপরাধীদের শেল্টারদান, মনোনয়ন ও দলীয় কমিটি বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার থেকে কমিশন আদায়, মামলার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে কারও কারও কাছ থেকে কোটি টাকার জমি লিখে নেওয়ারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে ওদুদ বিশ্বাস যে হলফনামা নির্বাচন কমিশনে দাখিল করেছিলেন তাতে তিনি পৈতৃক সূত্রেপ্রাপ্ত কৃষি জমির পরিমাণ উল্লেখ করেছিলেন নিজের নামে ৩০ বিঘা এবং স্ত্রীর নামে ছয় বিঘা। যৌথ মালিকানার দুই বিঘা দালানে ওদুদের অংশের মূল্য ছিল দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০০৮ সালে স্থায়ী সম্পদ হিসেবে রাজশাহীর সোনাদিঘি মোড়ের একটি তিনতলা বাড়ি এবং নিজ গ্রাম মহারাজপুরে ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ছয়টি দোকানঘর থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের সর্বশেষ নির্বাচনে ওদুদের দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে দেখা যায়, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ১৫ বছরে ওদুদের সম্পদ বেড়েছে শত গুণের বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঢাকাতে জমি, মার্কেট, অ্যাপার্টমেন্ট ও বাড়ির ছড়াছড়ি।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহী নগরীর কোর্ট ঢালান এলাকায় ২২ কাঠা জমির ওপর ওদুদ একটি মার্কেট করছেন। এসব জমির প্রতি কাঠার মূল্য ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। এই জমি ও মার্কেটের বর্তমান দাম ২৫ কোটি টাকার বেশি। ২০০৮ সালে মৌসুমি ব্যবসা থেকে তার বার্ষিক আয় ছিল ৪০ হাজার টাকা। বর্তমানে তার ব্যবসার মূলধন বেড়ে হয়েছে ১০ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার টাকা। ২০২৩ সালে ওদুদ বিশ্বাসের নিজ নামে জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৭ বিঘা। ১৪ বছর পর পৈতৃক ও ক্রয়সূত্রে ওদুদ বিশ্বাসের অকৃষি জমির পরিমাণ ১০ বিঘা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ বিঘা। এমপি হওয়ার আগে তার হাতে নগদ টাকা ছিল তিন লাখ ৯৪ হাজার। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে হাতে নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৪০ লাখ। বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী জমার পরিমাণ ১০ লাখ টাকা। এমপি হওয়ার আগে ওদুদ বিশ্বাসের ছিল ৩০ হাজার টাকা দামের একটি মোটরসাইকেল। এখন মোটরসাইকেল ছাড়াও একটি ট্রাক, একটি জিপ গাড়ি ও একটি ট্যাংকলরি রয়েছে। এর মধ্যে এমপি কোটায় আমদানি করা দুটি গাড়ি বিক্রি করে তিন কোটি টাকা পেয়েছেন বলে ওদুদ বিশ্বাস দাবি করেছেন।
আয়কর ফাইলের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, নিজ নামে ৫ ভরি সোনা, স্ত্রীর ৮০ ভরি ও দুই মেয়ের ১২০ ভরি সোনা রয়েছে। এমপি হওয়ার আগে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া বাদে নিজের নামে কোনো বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ছিল না। বর্তমানে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে তিনটি বাড়ির মালিক হয়েছেন। ঢাকায় আছে তিনটি ফ্ল্যাট। এমপি হওয়ার পর নিজ এলাকা ঘোড়া স্ট্যান্ড মোড়ে করেছেন একটি পেট্রোল পাম্প। চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনুপনগরে কিনেছেন তিন কোটি টাকা মূল্যের একটি অটো ইটভাটা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী নগরীর সোনাদিঘি মোড়ের চারতলা বাড়িটি এমপি হওয়ার পর সাততলা করেছেন ওদুদ। রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্রে সাততলা এই বাড়িটির বর্তমান মূল্য পাঁচ কোটি টাকার বেশি। রাজশাহীর নবীনগর মৌজার অধীন চারলেন বিমানবন্দর সড়ক ঘেঁষে ৩০ কাঠা জমির ওপর নির্মাণ করেছেন তিনতলা মার্কেট। রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই মার্কেটের শুধু জমির দামই ১৫ কোটি টাকা বলে এলাকাবাসী জানান। এমপি হওয়ার পর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের পুরাতন জেলখানা মোড়ে শূন্য দশমিক ৭৮১ একর জমি কেনেন ওদুদ। সেই জমিতে নির্মাণ করেন তিনতলা বাড়ি। এই ভবনের উপর তলায় ওদুদ বসবাস করতেন। তার আয়কর ফাইলে এই জমিসহ বাড়ির মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৩৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বর্তমানে বাড়িটির মূল্য তিন কোটি টাকার বেশি বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ওদুদ এমপি হওয়ার পর রাজশাহীর সিরোইল মৌজায় শূন্য দশমিক ১০৬৭ একর জমি কিনেছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরজোতপ্রতাপ এলাকায় কিনেছেন শূন্য দশমিক ৮০০ একর জমি। রাজশাহী নগরীর বড়বনগ্রাম মৌজায় দশমিক ০৯৫০ একর জমি কেনেন নিজ নামে।
নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের কোচলাপাড়া মৌজায় ১ দশমিক ৪৬০০ একর জমি, অনুপনগর মৌজায় ২ দশমিক ২৭৫০ একর, কোচলাপাড়ায় ১ দশমিক ১৯ একর, দক্ষিণশহর মৌজায় দশমিক শূন্য ৩৪০০ একর, কোচলাপাড়ায় ১ দশমিক ২৯০০ একর এবং রানীহাটি মৌজায় দশমিক শূন্য ২৩০০ একর জমি কিনেছেন এমপি ওদুদ। এছাড়া এমপি হওয়ার পর একটি দোনলা বন্দুক ও একটি পিস্তল কিনেছেন যার মূল্য দেখিয়েছেন দুই লাখ টাকা। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের দক্ষিণ শহর এলাকায় ওদুদের প্রায় ৭০ বিঘা জমির ওপর একটি বিশাল খামারবাড়ি রয়েছে। ঢাকার কলাবাগান এলাকায় একাধিক অ্যাপার্টমেন্ট থাকলেও সেগুলো তিনি আয়কর ফাইলে দেখাননি। ঢাকার গিলগাঁও এলাকায় থাকা দুটি ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। আয়কর ফাইলে খিলগাঁও এলাকার ফ্ল্যাট দুটির মূল্য দেখিয়েছেন ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা।