বগুড়ায় দিনভর অসহযোগ আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। থানা ও পুলিশের ওপর হামলার সময় গুলিতে সদরে চারজন ও দুপচাঁচিয়ায় একজন নিহত হয়েছেন। তিনজনের মরদেহ বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালে ও একজনের কাহালুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী সাধারণ জনগণ দাবি করেছেন, সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেও বিএনপি ও নিষিদ্ধ জামায়াতের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের হেলমেটধারীরা এসব নাশকতা ও হামলা চালিয়েছে।
নিহতরা হলেন- বগুড়ার কাহালু উপজেলার বীরকেদার ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া গ্রামের সামসুল ইসলামের ছেলে, নওগাঁর বদলগাছীতে বঙ্গবন্ধু সরকারি কলেজের অনার্স (ইতিহাস) পঞ্চম বর্ষের ছাত্র মনিরুল ইসলাম মনির (২২) ও গাবতলীর জিল্লুর রহমান (৪৫), সেলিম রেজা (৪৫)। অপর দুজনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এদের একজন শহরের সাতমাথায় ডাকবাংলোর সামনে, একজন ৩ নম্বর রেল ঘুমটির কাছে, দুজন শহরের অন্যত্র এবং অপরজন দুপচাঁচিয়ায় নিহত হয়েছেন।
বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আবদুল ওয়াদুদ জানান, গুলিতে নিহত চারজনের মরদেহ মর্গে হয়েছে। হাসপাতালে ২২ জন ভর্তি হয়েছেন। তার ধারণা, গুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
বগুড়া মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শফিক আমিন কাজল বলে, এখানে দুজন ভর্তি হয়েছেন।
কাহালুর বীরকেদার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম হোসেন জানান, দুপচাঁচিয়ায় পুলিশের গুলিতে তার এলাকার কলেজছাত্র মনিরুল ইসলাম মনির নিহত হয়েছেন। তার লাশ নিয়ে মিছিল শেষে দাফনের জন্য বাড়িতে আনা হয়েছে। লাশ পুলিশকে দেওয়া হয়নি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বগুড়ায় বিভিন্ন স্থানে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষে শতাধিক পুলিশ ও আন্দোলনকারী আহত হন। আন্দোলনকারীরা শহরের সাতমাথায় জেলা আওয়ামী লীগ ও জেলা ছাত্র ইউনিয়ন এবং বিটিসিএল কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও আগুন দেন। শহরের বড়গোলা এলাকায় সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে কয়েক দফা হামলার পর আগুন দেওয়া হয়। দরজা ভেঙে ফেলার পর অফিস থেকে মূল্যবান কাগজপত্র ও আসবাবপত্র রাস্তায় এনে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। আসবাবপত্র ও অন্যান্য মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। বেলা পৌনে ৬টায় এ খবর পাঠানোর সময় ভূমি অফিস দাউ দাউ করে জ্বলছিল।
হামলাকারীরা একই এলাকায় সিটি ব্যাংকে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। তারা আশপাশের বিভিন্ন অফিসে ঢিল ছুঁড়ে কাঁচ ভেঙে ফেলে। সাইনবোর্ড ও সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়। দত্তবাড়ি এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলম মোহনের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, আসবাবপত্র বাহিরে এনে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়। এছাড়া শহরের শিববাটি এলাকায় বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাসভবনে হামলা ও তার ব্যক্তিগত গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়।
নাম ও পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ছাত্র জানান, তারা নয় দফা দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চেয়েছিলেন। কিন্তু নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির ও বিএনপি অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের সন্ত্রাসীরা ভূমি অফিসসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া শুরু করে। এতে তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ সময় কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ফল দেওয়া হচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা জেলার বিভিন্ন উপজেলার প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় অবস্থান নেয়। তারা গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে গাছের গুঁড়ি, ইট, টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। তারা হ্যান্ডমাইকে প্রতিটি বাড়ি থেকে সবাইকে লাঠিসোটা হতে বের হতে আহবান জানান। তাদের আহবানে বিএনপি ও নিষিদ্ধ জামায়াত সমর্থকরা লাঠিসোটা হাতে রাস্তায় বের হন।
রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে শহরের সাতমাথায়, দত্তবাড়ি, বড়গোলা ও থানা মোড় এলাকায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থান নেন। বেলা ১১টার দিকে আন্দোলনকারীরা শহরের জিরো পয়েন্ট সাতমাথায় এলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়। আন্দোলনকারীদের ধাওয়ায় ক্ষমতাসীনরা পিছু হটে। পুলিশ টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে আন্দোলনকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে সাতমাথা ত্যাগ করেন।
এরপর আন্দোলনকারীরা শহরের সাতমাথা টেম্পল রোডে জেলা আওয়ামী লীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও বিটিসিএল কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করেন। তারা অনেক ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে আগুন দেন। পুলিশ বাধ্য হয়ে রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করলে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ ও আন্দোলনকারী আহত হন।
শহরের দত্তবাড়ি ও বড়গোলায় অবস্থান নেওয়া বিপুলসংখ্যক নারী ও পুরুষ আন্দোলনকারী থানা পেরিয়ে সাতমাথার দিকে যেতে চায়। বড়গোলা থেকে ইটপাটকেল ও গুলতি দিয়ে মার্বেল ছুড়লে পুলিশ টিয়ারশেল এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করতে থাকে। এরপর থেকে এ খবর পাঠানো পর্যন্ত আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিয়ে পুলিশ ও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালায়।
হেলমেট পরিহিত দুর্বৃত্তরা সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে কয়েক দফা হামলা চালিয়ে প্রধান ফটক ভেঙে ফেলে। এরপর তারা অফিসে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর, মূল্যবান কাগজপত্র ও আসবাবপত্র রাস্তায় এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আনতে না পারায় ভূমি অফিস পুড়তে থাকে। তারা সিটি ব্যাংকের ওপর বেশি হামলা চালায়। এছাড়া সেখানে ব্র্যাক ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়ে হামলা করে ব্যাপক ভাংচুর করে।
বড়গোলায় আকবরিয়া হোটেলের প্রতিষ্ঠান ড্যান্সিং কাপও ভাঙচুর করা হয়েছে। একই এলাকায় জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জুরুল আলমের ব্যক্তিগত কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও আসবাবপত্র রাস্তায় এনে আগুন দেয়। ওই কার্যালয়ে লুটপাট করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শহরের শিববাটি এলাকায় বগুড়া সদর আসনের সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসান রিপুর বাড়িতে হামলা ও তার গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। শহরের বড়গোলায় ভাণ্ডারী লেনে অধিকাংশ বাড়ি থেকে নারী ও পুরুষরা হামলাকারীদের সহযোগিতা এবং টিয়ারশেল থেকে বাঁচতে পেস্ট ও আগুন জ্বালাতে টায়ার এবং কাগজ সরবরাহ করেন। তারা বোতলে বোতলে পানি দিয়ে যান। হামলা চলাকালে জেলা মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিহার সুলতানা তিথির নেতৃত্বে নারীদের বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শহরের বড়গোলা এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক আন্দোলনকারী সদর থানার সামনে অবস্থান নেওয়া পুলিশের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এ সময় ৩ নম্বর রেলঘুমটি এলাকায় ‘গুলিবিদ্ধ’ হয়ে এক যুবক মারা যান। এরপর শহরের সাতমায় ডাকবাংলোর সামনে একজন এবং অন্যত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে শহরের নামাজগড় এলাকায় স্বদেশ ক্লিনিকে একজন মারা যান। তিনটি লাশ উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
অন্যদিকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায় বেলা সাড়ে ১০টার দিকে বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী জেকে কলেজ রোড হতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। তারা সিও অফিস বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছলে তাদের সাথে বিএনপি ও নিষিদ্ধ জামায়াত এবং তাদের অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা একত্রিত হন। তারা পুলিশের সামনে পুলিশ বক্স ভাংচুর করে। পরে তারা উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। তাদের মারপিটে আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন আহত হন।
বিক্ষোভ মিছিল দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদ সড়কে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে পিছু হটে থানায় অবস্থান নেয়। আন্দোলনকারীরা এ সময় প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবার রহমান তালুকদার মুকুলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেন।
এরপর তারা থানা আক্রমণ করতে গেলে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। তখন কাহালু উপজেলার বীরকেদার মণ্ডলপাড়ার মনিরুল ইসলাম মুনির নামে এক কলেজছাত্র গুলিবিদ্ধ হন। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ওই সময় অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এলে তাদের মধ্যে ১০ জনকে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আন্দোলনকারীরা নিহত মনিরের মরদেহ নিয়ে থানার দিকে গিলে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে তাদের তাড়িয়ে দেয়।
দুপচাঁচিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোছা. শামসুন্নাহার জানান, কলেজছাত্র মনির মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।
অন্যদিকে আন্দোলন চলাকালে শহর ও শহরতলি এবং বিভিন্ন উপজেলায় দোকানপাট বন্ধ ছিল। অফিস আদালত খোলা হয়নি। সব ধরনের যানবাহন চলাচল করতে দেওয়া হয়নি। প্রতিটি সড়কে গাছের গুঁড়ি, ইট ও অন্যান্য জিনিসপত্র দিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। লাঠিসোটা হাতে মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেওয়া নারী ও পুরুষ ছোট যানবাহনগুলো বের হলে তাড়িয়ে দেন। আন্ত:জেলা ও দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। জরুরি প্রয়োজনে বের হওয়া নারী ও পুরুষকে হেঁটেই গন্তব্যে যেতে হয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার জাকির হাসান সদর ও দুপচাঁচিয়া থানায় হামলার কথা নিশ্চিত করেন। তবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে হতাহতের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি।