বিচার চেয়ে স্রষ্টার কাছে মায়ের আর্তনাদ
বড় সন্তান সাব্বিরকে হারিয়ে শোকে পাথর পরিবার
মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৮:২৭ পিএম
নিহত সাব্বির হোসেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামের সন্তান সাব্বির হোসেন (২৩) থাকতেন ঢাকার উত্তরা-আজমপুর এলাকায়। গত ১৮ জুলাই দুপুরে ওষুধ কিনতে বের হয়েছিলেন তিনি। এ সময় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় একটি গুলি এসে লাগে তার গলায়। মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে একটি কোম্পানিতে স্বল্প বেতনে চাকরি করতেন সাব্বির। সেই টাকা বাড়িতে পাঠাতেন। তা দিয়ে এক ভাই ও বোনের লেখাপড়ার খরচ চলত।
কালীনদীর বাঁকে গড়ে ওঠা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মীর্জাপুর গ্রামে মঙ্গলবার গেলে সাংবাদিক দেখে ছুটে আসেন গ্রামের বেশ কয়েকজন শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ। নদীর পাড়ে জঙ্গলে ঘেরা কবরস্থান দেখিয়ে দিলেন তারা। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা নতুন কবরটি চোখে পড়ল। মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় ধারণ করা সাব্বিরের রক্তাক্ত মরদেহের ছবি দেখালেন কয়েকজন যুবক। গুলিবিদ্ধ লাশ গ্রামে আনার পর ছবি তুলেছিলেন তারা। গ্রামজুড়ে শোকের আবহ বিরাজ করছে। বাকরুদ্ধ পরিবারের সদস্যরা। মা রাশেদা বেগম বারান্দায় বসে শূন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করছেন। কান পাততেই শোনা গেল মহান স্রষ্টার কাছে সন্তান হত্যার বিচার চাইছেন তিনি।
পরিচয় দিতেই প্রতিবেদকের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। এরপর চোখের পানি ফেলে বলতে লাগলেন, ১৮ জুলাই উত্তরা-আজমপুর এলাকায় গুলিতে নিহত হয়েছে তার বড় সন্তান সাব্বির হোসেন। তরতাজা যুবক সাব্বির উত্তরার ১৩নং সেক্টরে অর্গান লিমিটেড কেয়ার নামে চাচাতো ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনতে বের হয়েছিল সে। বাসা থেকে বের হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশের ছোড়া গুলি এসে লাগে তার ঘাড়ের বামদিকে। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় গলার একটি অংশ। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়ে। ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ওইদিন বিকাল ৫টার দিকে বড় সন্তানের মৃত্যুর খবর আসে তার কাছে। গভীর রাতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই মরদেহ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়িতে।
পরের দিন (১৯ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয় সাব্বিরের মরদেহ। সেদিন হাজারো মানুষ জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। চোখের জল ফেলেছেন তারাও। নিরীহ সহজ-সরল হাসিখুশি সাব্বিরের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কেউ। জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ঝিনাইদহ-১ আসনের সংসদ-সদস্য নায়েব আলী জোয়ারদার, শৈলকুপা থানার ওসি সফিকুল ইসলাম চৌধুরীসহ অনেকে।
নিহত সাব্বির হোসেন মীর্জাপুর গ্রামের আমোদ আলীর বড় ছেলে। রাশেদা-আমোদ আলী দম্পতির দুই ছেলে এক মেয়ে। সাব্বির পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন। বোন সুমাইয়া স্থানীয় একটি কলেজে এইচএসসি প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ভাই সাদিক হোসেন ঝিনাইদহ সদর উপজেলার মধুপুর এলাকার একটি হাফেজিয়া মাদ্রাসায় ১৫ পারা কুরআনে হেফজ করেছেন। আমোদ আলী চাষযোগ্য এক বিঘা জমির মালিক। অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন। রাশেদা বেগম বাড়ির আঙিনায় গরু-ছাগল পালন করেন। বছর শেষে সেগুলো বিক্রি করে বাড়তি আয় হয় তাদের। ১০ কাঠা জমির ওপর আধাপাকা বাড়ি। সাত মাস আগে চাকরি নেন।
বেতন পেতেন ১০/১২ হাজার টাকা, যা পাঠাতেন মায়ের কাছে। সুখী এ পরিবারটির জন্য বেদনার দিন হয়ে উঠে ১৮ জুলাই। ছোট বোন সুমাইয়া বলেন, আমার ভাই কোনো দল করেনি। সাধারণ একজন শ্রমজীবী। কেন তার ভাইকে হত্যা করা হলো? আমোদ আলী শোকে পাথর। বাড়িতে পাওয়া গেল না তাকে। সাব্বিরের মা জানান, ১২ দিনের মধ্যে কেউ খোঁজ নেয়নি তাদের। আসেননি প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তি।
এ সময় আড়ষ্ট কণ্ঠে মা রাশেদা বেগম খোলা আকাশের দিকে দুই হাত তুলে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহ তুমি সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদে সাড়া দাও। বিচার করো আমার সন্তানের হত্যাকারীদের।’ এ সময় প্রতিবেশী এক মায়ের কোলে থাকা ফুটফুটে শিশুর কান্নায় আরও ভারী হয়ে উঠে এলাকার বাতাস। উপস্থিত সবার চোখ বেয়ে নীরবে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।