মো. ফয়েজ (৩১)। লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে উত্তর চরআবাবিল ইউপির ঝাউডুগী গ্রামের বাসিন্দা। প্রায় ১২ বছর আগে সংসারের হাল ধরতে ঢাকায় গিয়েছিলেন ফয়েজ। সেই থেকেই স্যানিটারি মিস্ত্রির (পাইপ ফিটার) কাজ করতেন তিনি। ঢাকার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতের খবর পেয়ে ছেলে মো. ফয়েজকে (৩১) কল দেন তার মা সবুরা বেগম।

এ সময় ছেলে বললেন, ‘অনবরত গুলি হচ্ছে। আমি কাজ শেষ করে বের হয়েছি। মা, এখন ফোন রাখ।’ এই কথাগুলোর একপর্যায়ে হঠাৎ গুলির বিকট শব্দ পান মা। এরপর সব স্তব্ধ। ছেলের আর কোনো কথা শুনতে পাননি তিনি।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ২১ জুলাই রোববার সন্ধ্যায় ৬টার দিকে ঢাকার রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মো. ফয়েজ। আহতাবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চরআবাবিল ইউপির ঝাউডগী গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন তিনি।

গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে হাসপাতালে নিয়েছিলেন তার পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম। রোববার মোবাইল ফোনে কথা হয় তার সঙ্গে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, চাঁদা তুলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে তিনি আহত মো. ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি মাথায় ও ঘাড়ে গুলিবিদ্ধ হন বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন। পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে তার লাশ রায়পুরের ঝাউডুগি গ্রামের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়।

ঠিকাদার কাশেম আরও জানান, ফয়েজ তার সঙ্গে দুই বছর ধরে কাজ করছিলেন। দিনে ৭০০ টাকা মজুরি পেতেন। সামান্য এই আয় দিয়ে স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ২১ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টায় সাইনবোর্ড এলাকার একটি ভবনে কাজ শেষ করে বাসার দিকে যাচ্ছিলেন। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

স্বামী ফয়েজের পর নুর নাহার ও তার ১৮ মাস বয়সি ছেলে রাফি মাহমুদের ঠাঁই মিলেছে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর এক স্বজনের বাসায়। মোবাইল ফোনে কথা হলে কেঁদে কেঁদে নুর নাহার বলেন, ‘স্বামী আমার আশ্রয়, সম্বল সবকিছু ছিল। তাকে গুলি করে মারল। কোন দোষে মারল তাকে, কে এই জবাব দেবেন?’

ঘটনার সাত দিন পেরিয়ে গেলেও কান্না থামেনি ফয়েজের মা সবুরা বেগমের। কেঁদে কেঁদে তিনিও বলেন, ‘গুলি করে আমার ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। ছেলে তো আর ফিরে আসবে না। ওর অসহায় বউ আর ছেলেকে কে দেখবে?’

রোববার সকালে ফয়েজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশেই তার চিরনিদ্রার জায়গা। সেখানে এক এক করে দেখতে আসছেন স্বজনরা। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন আর দোয়া করে চলে যাচ্ছেন।

ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন আক্ষেপ করে বলেন, ‘দুটি গুলি আমার ছেলেটারে শেষ করে দিল! ছেলে হত্যার বিচার চাই। কিন্তু কার কাছে বিচার চাইব? আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে আমি চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে ছেলেকে হারালাম।’ আল্লাহর কাছে বিচার চাইলাম।।