Logo
Logo
×

সারাদেশ

কোটাবিরোধী আন্দোলন: কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন

Icon

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১০:২৬ পিএম

কোটাবিরোধী আন্দোলন: কুড়িগ্রামে তিন লাশ দাফন

ছবি: যুগান্তর

ঢাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় গুলিতে প্রাণ হারান কুড়িগ্রামের তিন তরুণ। মৃতরা হলেন- উলিপুর উপজেলার ব্যাংক কর্মকর্তা রায়হানুল ইসলাম (৩৫), সদর উপজেলার রাজমিস্ত্রি নুর ইসলাম (২২) এবং নাগেশ্বরী উপজেলার রাজমিস্ত্রি গোলাম রব্বানী (২০)। তারা কেউ আন্দোলনে বা রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না বলে জানা গেছে। এখন পর্যন্ত এই তিন পরিবারকে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কেউ কোনো সহায়তা করেনি বলে জানা গেছে। 

দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন ব্যাংক কর্মকর্তা রায়হানের স্ত্রী রিতু

জেলার উলিপুর উপজেলার পৌর শহরের মুন্সিপাড়ার আব্দুর রশিদের একমাত্র সন্তান রায়হানুল ইসলাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আব্দুর রশিদ একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে একেবারে বাকরুদ্ধ। রায়হানুলের স্ত্রী রিতু আক্তার আর তাদের ভালোবাসার ফসল মেয়ে রাওযানমনি (৪ মাস)। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রায়হান বাড়িতে আসে পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। সব ঠিকঠাক চলছিল, ঢাকার বাড্ডা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিবার নিয়ে সেখানে উঠবেন, এমন স্বপ্ন বুনে যান স্ত্রী রিতু আক্তারের মনে। এ দেখা যে শেষ দেখা হবে এমন ভাবনা দুঃস্বপ্নেও দেখেনি পরিবারের কেউ। বাড়িতে কান্নার রোল কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছে না মেয়ে রাওযানমনি। তার মনে কোনো স্মৃতিই থাকবে না বাবাকে নিয়ে। সে তার মতোই অস্পষ্ট বাক্যে বলছে নানা কথা। হাসছে খেলছে। মেয়ের পাশে বসে আছেন রিতু আক্তার। দুই চোখে অন্ধকার দেখছেন- কী হবে তাদের আগামী জীবন। তিনি রাষ্ট্রের কাছে বিচার চান, চান ক্ষতিপূরণ। 

বাবা আব্দুর রশিদ জানান, রায়হানুল ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্র ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে চাকরি হয় একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেখানে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে কাজ করত। তিনি প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে বলেন, গত শুক্রবার ১৯ জুলাই বাড্ডা এলাকায় জুমার নামাজ শেষে রাস্তায় নামলে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী আর পুলিশের সংঘর্ষের মাঝে পড়েন। এরই মধ্যে এক সময় একটি গুলি তার ডান চোখের কাছে লেগে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। ফলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। 

ওই দিন রাত ১০টায় রওনা দিয়ে পরদিন শনিবার সকালে উলিপুরে লাশ পৌঁছে। সকাল সাড়ে ১১টায় এমএস স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানাজা শেষে উলিপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়। তিনি বাবা হিসেবে খুব অসহায় বোধ করছেন।  তিনি বলেন, আমার আর কোনো স্বপ্ন রইল না।

সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারল না রাজমিস্ত্রি নুর আলম 

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের ভাগিরভিটা গ্রামের আমির হোসেনের দুই ছেলের মধ্যে নুর আলম বড়। বাবা আমির হোসেন ভ্যানচালক আর মা নুর বানু গার্মেন্টস কর্মী। নুর আলম ছিলেন রাজমিস্ত্রি। সবার ছোট নুর জামাল (১৪) থাকত অন্যের দোকানের কর্মচারী হিসেবে। নুর আলম প্রায় এক বছর আগে বিয়ে করেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী খাদিজা গৃহবধূ আর সবাই কর্মজীবী। সবমিলিয়ে তাদের ছিল সুখের সংসার। পরিবারের সবাই মিলে ভাড়া থাকতেন গাজীপুর চৌরাস্তার তেলিপাড়া এলাকায়। 

বাবা আমির হোসেন প্রত্যক্ষদর্শী আশিক ও আব্দুল্লাহর বরাতে জানান, শনিবার (২০ জুলাই) সকাল ৯টার দিকে ঠিকাদারের সাইডের কাজ থেকে ফেরার পথে চৌরাস্তা এলাকায় গোলাগুলিতে পড়েন। একপর্যায়ে ডান চোখে গুলি লাগলে ঘটনাস্থলে লুটে পড়েন। পরে অন্যরা ধরাধরি করে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার ডা. আবিদ বিল্লাহ তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর তারা লাশ নিয়ে যান জয়দেবপুর সরকারি হাসপাতালে। সেখান থেকে রাত ১০টায় লাশ হস্তান্তর করেন। পরদিন রোববার (২১ জুলাই) গ্রামের বাড়িতে লাশ নিয়ে আসি। সকাল সাড়ে ১০টায় জানাজা শেষে বাড়ির আঙিনায় দাফন করা হয়। 

মা নুর বানু বলেন, আমার পোলা রাজনীতি করে না। কাজ করে খায়। আমরা গরিব মানুষ। আমার পোলার কী অপরাধ। তাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এর কোনো বিচার নাই। আমি বিচার চাই, ক্ষতিপূরণ চাই। আমার বউমা ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার পোলাটা সন্তানের মুখও দেখে যেতে পারল না। কী হবে ওর স্ত্রী-সন্তানের। নুর বানুর এমন প্রশ্ন আর কান্নায় ভাগিরভিটা গ্রামের বাতাস ভারি হয়ে উঠে। 

ন্যায়বিচার চান রাজমিস্ত্রি গোলাম রব্বানীর বাবা

কোটা সংস্কার আন্দোলনে বিজিবির গুলিতে ঢাকার আফতাবনগরে মারা যান কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার কেদার ইউনিয়নের কচাকাটা বাজার এলাকার সাইদুর রহমানের ছেলে গোলাম রব্বানী (২০)। 

নিহত গোলাম রব্বানীর সহকর্মী একই এলাকার বাসিন্দা রাসেল ইসলাম (২২) জানান, তারা রামপুরা আফতাবনগরে থাকতেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় আফতাবনগরে ই-ব্লকে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন তারা। এ সময় রাতের খাবার খেতে পাশের খাবারের দোকানে যাওয়ার পথে আকস্মিক বিজিবির ছোড়া ছররা গুলিতে আহত হন গোলাম রব্বানী। পেটের নিচে গুলি লাগে তার। তাকে দ্রুত পাশের একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তৃপক্ষ ফিরিয়ে দেন। পরে সেখান থেকে শ্যামলীর একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরে লাশ কুড়িগ্রাম নিয়ে আসেন রাসেল ইসলাম।   

গত শনিবার (২০ জুলাই) দিবাগত রাত সাড়ে ৯টার দিকে লাশ নিয়ে আসা হয় নাগেশ্বরীতে। রোববার (২১ জুলাই) সকাল ৯টায় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।  

রব্বানীর বাবা সাইদুর রহমান বলেন, আমার পোলাটা নিরপরাধ। রাজনীতির সঙ্গে নেই। ওর আয়ে আমাদের সংসার চলত। এখন আমাদের সংসার কেমনে চলবে? এ ঘটনার ন্যায়বিচার দাবি করেন তিনি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম