সাইনবোর্ড দিয়ে চলছে প্লট বিক্রি, শত কোটি টাকার সরকারি জমি বেদখল
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ০১:৪৮ পিএম
রাজশাহীর মোল্লাপাড়ায় গণপূর্তের জমিতে রিয়েল এস্টেটের কার্যালয় বসিয়ে চলছে প্লট বিক্রি। ছবি : যুগান্তর
রাজশাহীতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধিগ্রহণ করা বিপুল পরিমাণ জমি দখল করে প্লট বিক্রি করছে একটি ডেভেলপার কোম্পানি। গণপূর্ত বিভাগ জমি উদ্ধারে মামলা করলেও এখনও বন্ধ হয়নি প্লট বিক্রি।
অভিযোগ রয়েছে, ইরাম রিয়েল এস্টেট নামের একটি কোম্পানির নামে ভূমিদস্যু একটি চক্র সরকারি জমি দখলে নিয়ে প্লট বিক্রি করছেন। বেদখল হওয়ার ওই জমির পরিমাণ ১০ বিঘার কিছু বেশি। বর্তমান যার বাজার মূল্যে প্রায় শত কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাকিস্তান আমলে রাজশাহী নগরীর মোল্লাপাড়া ও আলীগঞ্জ মৌজায় ইটভাটা স্থাপনের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তর ৩০ দশমিক ৮১ একর ব্যক্তি মালিকানা জমি অধিগ্রহণ করেন। যার এলএ কেন নং ২১৪/৬১-৬২ ও ৮২/৬৩-৬৪। তবে জমিটির গেজেট করা হয় ২০১৫ সালের অক্টোবরে। কিন্তু এসব জমির মধ্যে কিছু কিছু দাগ হাল রেকর্ডে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ-২ এর নামে রেকর্ডভুক্ত না হয়ে যাদের কাছ থেকে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল তাদের নামেই নামজারি হয়। পরে এসব জমিতে থাকা ইটভাটা বন্ধ করে আম ও কাঁঠালসহ নানা ধরনের ফলের বাগান করা হয়। তবে কয়েক বছর আগে কতিপয় ব্যক্তি জমিগুলোর কিছু অংশ দখল করেন নিজেদের দাবি করে।
গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর গণপূর্ত অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় একটি জিডি করা হয়। এরপর পুলিশ দখলদারদের উচ্ছেদ করেন। এর কিছুদিন পর আবারও ওই চক্রটি সরকারি এসব জমি দখলের চেষ্টা করে। এসময় গণপূর্ত অধিদপ্তরের উদ্যোগে ২০২৩ সালের ৭ আগস্ট ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর দিলে গেলে দলখদারদের বাধায় তা পণ্ড হয়ে যায়। ফলে দখলদাররা আরও বেপরোয়া হয়ে এসব জমি প্লট আকারে বিক্রির শুরু করেন।
এ বিষয়ে ২০২৩ সালের ২০ আগস্ট রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (আরডিএ) একটি চিঠি দেন রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী এবিএম হুমায়ুন কবীর। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সরকারি জমি কতিপয় ব্যক্তি প্লট আকারে বিক্রি করছে। এসব জমিতে যেন এনওসি বা ভূমি ব্যবহারের ছাড়পত্র না দেওয়া হয় সেই চিঠিতে ‘আরডিএ’ কে অনুরোধ জানায় গণপূর্ত বিভাগ। একই সঙ্গে ২০২৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পবা উপজেলার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) আরেকটি চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে অধিগ্রহণকৃত জমির খাজনা ও নামজারি স্থগিত রাখতে অনুরোধ জানায় গণপূর্ত বিভাগ। ওই বছরই আদালতে মামলা করা হয় গণপূর্তের পক্ষে। এরপরও থেমে নেই প্লট কেনা-বেচা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, গণপূর্তের অধিগ্রহণ করা জমির ওপর দিয়ে কয়েক বছর আগেই ১৮ ফিট পাকা সড়ক নির্মাণ হয়েছে অবৈধভাবে। এই সড়কের দুইপাশে জমি প্লট আকারে বিক্রির সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। এই সাইনবোর্ড দিয়েছেন ইরাম রিয়েল এস্টেট নামের একটি ডেভেলপার কোম্পানি। প্লট বিক্রির জন্য জমির ওপর দখলদাররা একটি অফিস করেছেন। সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ইমাম হাসান, আরিফ, রুবায়েত, রাসেল ও মাসুদের মোবাইল নাম্বার দেওয়া হয়েছে। আরেকটি সাইন বোর্ডে লেখা ‘এই জমির মালিক মো. মাসুদ রানা। খরিদ সূত্রে জমির মালিক ইমাম হাসান দিগর। এই ইমাম হাসানই ইরাম রিয়েল এস্টেট চেয়ারম্যান।
অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, ইতোমধ্যে তাদের কাছ থেকে ৫নং প্লট কিনেছেন বন্ধন-২০০১ কেএইচএস, ৬নং প্লটটি কিনেছেন আনোয়ার সাদাত ও মিজানুর রহমান এবং ৭নং প্লট কিনেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের মন্তাসেরুল হক।
যোগাযোগ করা হলে মন্তাসেরুল হক বলেন, ‘মোল্লাপাড়া এলাকায় আমার বোনের বাড়ি। সেখানে বেড়াতে গিয়ে আমি প্লটের খোঁজ পাই। এরপর গত এপ্রিলে আমি মাসুদ রানার কাছ থেকে প্রতিকাঠা ২৭ লাখ টাকা দরে তিন কাঠার প্লটটি কিনেছি। তবে এখনো রেজিস্ট্রি হয়নি। কিন্তু কয়েকদিন আগে শুনলাম এই জমির মালিক গণপূর্ত। তারা আদালতে মামলা করেছে। শোনার পর মাসুদের কাছে আমি টাকা ফেরত চেয়েছি।
জানা গেছে, ৫নং প্লটের মালিক চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট এলাকার বাদশা আলমগীরসহ ১৩ জন। সোমবার আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কয়েক মাস আগে ইরাম রিয়েল এস্টেটের সাইন বোর্ড দেখে তারা যোগাযোগ করেন। এরপর ১৩জন বন্ধু মিলে সেখানে ভবন করার জন্য প্লট কেনেন ২০লাখ টাকা কাঠা দরে। ইতোমধ্যে তারা ২৫ লাখ টাকা তারা পরিশোধ করেছেন। এ মাসেই প্লট রেজিস্ট্রি হওয়ার কথা ছিল। এখন শুনছি জমিতে সমস্যা আছে।
এদিকে ইরাম রিয়েল এস্টেটের আবাসন প্রকল্পে গিয়ে দেখা হয় স্থানীয় বাসিন্দা হাবিবুর রহমান ও রুবেল মিয়ার সাথে। তারা জানান, জমির মালিক দাবিদারদের কাছ থেকে বায়না করেছে ইরাম রিয়েল এস্টেট। তাদের নিজের কোনো ইনভেস্ট নাই। মাঝখান থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে তারা। কিন্তু আমরা শুনেছি এগুলো সরকারি জমি।
মোসাব্বির হোসেন জনি নামে একব্যক্তি বলেন, ‘সড়কের পাশে এই জমির দাম ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা কাঠা। বিশাল জমি পড়ে আছে। যারা এই জমির ওপর নজর দিয়েছে, তারা প্রভাবশালী। প্লট আকারে বিক্রি করলে দু’বছরও লাগবে না। দুইশো কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে কেটে পড়বে।
এ দিকে ইরাম রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান পরিচয়দানকারী ইমাম বলেন, ‘আমরা জমির মালিক নই। গণপূর্ত যাদের জমি অধিগ্রহণ করেছিল তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। ওই মামলার আসামি আমরা নই। আমরা পাবলিকের কাছ থেকে জমি বায়না করে নিয়েছি। এরপর প্লট আকারে বিক্রি করছি। প্লট বিক্রি করে বায়না অনুযায়ী মালিককে আমরা টাকা পরিশোধ করছি।
রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এএইচএম শাকিউল আজম বলেন, জমি অধিগ্রহণের পর কিছু পরিমাণ জমি কাজে লাগেনি। এই সুযোগে আগের প্রায় ৫০ জন মালিক আবারো কাগজপত্র তাদের নামে নামজারি করে নিয়েছে। আমরা তা বাতিলের জন্য মামলা করেছি। আমরা আদালতের রায়ের অপেক্ষায় আছি। কিন্তু মামলা চলমান থাকার পরও কে বা কারা সরকারি জমি প্লট আকারে বিক্রি করে দিচ্ছে। এটা ঠেকাতে আরডিএ এবং এসি ল্যান্ডকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে পবার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অভিজিত সরকার জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষের গাফিলতিকে কিছু জমি আগের মালিকরা নিজেদের নামে খাজনা খারিজ করে নিয়েছেন। মামলা করলে এগুলো বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু এখন যারা না জেনেই প্লট বা জমি কিনছেন তারা ভবিষ্যতে বিপদে পড়তে পারেন। কারণ গণপূর্তই জমি ফেরত পাবে।