ঘুষ-দুর্নীতি নিয়ে বয়ানের পর ইমামের চাকরিচ্যুতির অভিযোগ, যা জানা গেল
বিবিসি বাংলা
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৪, ০৩:২০ পিএম
চাঁদপুরের মতলবে একটি মসজিদের ইমাম অভিযোগ করছেন যে, ঘুষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে জুমার নামাজের আগে বয়ানের কারণে মসজিদ কমিটি তাকে চাকুরিচ্যুত করেছে।
তবে মসজিদ কমিটির সভাপতি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করার কারণে এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ওই ইমামকে যথাযথ নিয়ম কানুন মেনে চাকুরি থেকে বিদায় দেওয়ার কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।
মতলবের উত্তর উপজেলার পৌর এলাকার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে স্থানীয়দের মধ্যে ইমাম ও মসজিদ কমিটিকে নিয়ে বিভেদ তৈরি হয়। ইমামের পক্ষে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকটি পরিবারকে একঘরে করার চেষ্টার অভিযোগ উঠেছে। এমন সিদ্ধান্তে অসহায় হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আপাতত এর সমাধান করেছেন।
কী ঘটেছে: ইমাম ও অন্যরা কী বলছেন
চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ছেঙ্গারচর পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন মো. রহমত উল্লাহ। কুরবানির ঈদের পরের শুক্রবারে জুমার নামাজের বয়ান শেষে তাকে ঘিরে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
রহমত উল্লাহ জানান, নামাজের সালাম ফেরানোর পরপরই মসজিদ কমিটির সভাপতি সানা উল্লাহ দাঁড়িয়ে বলেন যে ‘এই হুজুরের চাকরি থাকবে না। এ মাসের বেতন দেওয়া হবে। উনি চলে যাবেন। আমি জুমার নামাজের বয়ানে বলেছি যে আমরা মুসলমান, কুরআন হাদিস মোতাবেক জীবন চালাতে হবে। হালাল আয় করতে হবে। হালাল খেলে ইবাদত কবুল হবে। হারাম খেলে হবে না। তাই হারাম থেকে সবার দূরে থাকতে হবে। সুদ ও ঘুষ খাওয়া এবং ব্যবসা করার সময় ক্রেতাদের পরিমাণে কম দেয়া হারাম। এরপর নামাজের সালাম ফেরানোর আগেই সভাপতি দাঁড়িয়ে গেলেন। এ নিয়ে হট্টগোল হলো। মুসল্লিরা কেউ কেউ বললেন হুজুরের কী দোষ। এক পর্যায়ে আমি নিজেই বললাম যে ঠিক আছে আমি থাকবো না। আমার যা পাওনা সেটি দিয়ে দিন। আমাকে তিন মাসের বেতন দেয়া উচিত কারণ আমি ওনাদের কারণে যাচ্ছি, নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছি না।
স্থানীয় কয়েকজন জানিয়েছেন, এরপর মসজিদেই তীব্র হট্টগোল হলে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয় যে সেদিন রাতেই এশার নামাজের পর স্থানীয়রা বসে সমস্যার সমাধান করবেন। এর মধ্যে বাইরে থেকে লোকজন এসে তাকে শাসিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেছেন রহমত উল্লাহ।
তিনি বলেন, এশার নামাজের পর সবাই বসলো। আমি আমার কথা বলেছি। উনারা গালিগালাজ করেছেন আমাকে। তারা আমাকে মারতে চেয়েছিলো। সেজন্য পরদিন থানায় গিয়েছি। এরপর থানা থেকে সবার সাথে কথা বলা হয় এবং আমার সব পাওয়া মিটিতে দিতে বললে কমিটির লোকজন রাজী হয়।
যদিও মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সানা উল্লাহ বলছেন, ইমাম সাহেবের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। উনাকে আমরা আগেই জানিয়েছিলাম। কারণ উনি ঠিক মতো দায়িত্ব পালন করেননি । হুটহাট অনুপস্থিত থাকতেন। বাচ্চাদেরও ঠিক মতো পড়াননি। ঈদের আগে বাদ দেওয়া হয়নি মানবিক কারণে। সেজন্য ঈদের পরের শুক্রবারের নামাজের পর মুসল্লিদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ইমাম রহমত উল্লার দাবি মসজিদ কমিটির সভাপতির বক্তব্যই অসত্য।
তিনি বলেন, আমি একদিনও অনুপস্থিত ছিলাম না। প্রতিদিন বাচ্চাদের ঠিকমতো পড়িয়েছি। ঠিক মতো নিজের ডিউটি করেছি। মাসে তিনদিন ছুটি পাওয়ার কথা থাকলেও অনেক সময় তা নেইনি। বরং আমি মনে করি বয়ানের কারণেই তারা আমার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
যদিও মসজিদ কমিটির সভাপতি বলছেন, তাকে বাদ দেওয়ার সাথে বয়ানের কোন সম্পর্কই নেই।
ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে চার পরিবার সমাজচ্যুত
এদিকে ওই ঘটনার পর স্থানীয় কয়েকজন ফেসবুকে ইমামের চাকুরিচ্যুতির প্রতিবাদ করে পোস্ট দেয়ায় তাদের ওপর চাপ তৈরির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পৌরসভার এক নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিল মোহাম্মদ সবুজ মিয়া বলছেন, সবার সাথে আলোচনা করে এখন মসজিদে নতুন ইমাম নেওয়া হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও এডিশনাল পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন শুক্রবার এখানে এসে নামাজ পড়ে সবার সাথে কথা বলে মিটমাট করে দিয়েছেন। এখন আর সমস্যা নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একি মিত্র চাকমা, স্থানীয় এডিশনাল পুলিশ সুপার ও দুদকের একজন কর্মকর্তা গতকাল শুক্রবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
তিনি বলেন, ইমাম সাহেবকে ঘুষ ও সুদের বয়ানের জন্য বাদ দেওয়া হয়নি। আমরা সবার সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছি যে আগেই অন্য কিছু কারণে তাদের বিদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। সেজন্য এক মাসের বেতন দিয়ে বিদায় দিয়েছে মসজিদ কমিটি। তবে কেউ কেউ তার বিদায়ের বিপক্ষে ছিলো।
তিনি অবশ্য জানান মসজিদ কমিটি কিছু ব্যক্তির উপর ক্ষুব্ধ হয়েছে কারণ তারা কমিটির বিরুদ্ধে ইমামকে নিয়ে বিভিন্ন পোস্ট দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমে। তাদের দাবি ছিলো যারা পোস্ট দিয়েছে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। আমরা তাদের সবার সাথেই কথা বলেছি। কমিটি বলেছে এখন সবাই মিলেমিশেই নামাজ পড়বে। কয়েকজনকে সমাজচ্যুত করার যে অভিযোগ উঠেছে তার সমাধান হয়েছে। তারপরেও কারও সম্মানহানি হলে আইনি প্রতিকার আছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বলছেন স্থানীয়রা এবং মসজিদ কমিটি- সবাই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন এবং আপাতত বিষয়টিকে নিয়ে আর কোন সমস্যা নেই বলে জানান তিনি।