ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ (ভায়া ভৈরব) সিলেট নৌরুটসহ দেশের বিভিন্ন নদীপথের আতঙ্কের নাম বালু, পাথর ও কয়লা পরিবহণের কাজে ব্যবহৃত নৌযান ‘বাল্কহেড’। নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ড ম্যানেজ করে চলাচল করছে তিন হাজারেরও বেশি ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন অবৈধ বাল্কহেডসহ সাড়ে ১১ হাজারেরও বেশি বাল্কহেড। এসবের অধিকাংশেই মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি নিয়ে চলাচলের কারণে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
সর্বশেষ ২২ মার্চ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনা নদীর শহিদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতুর কাছে বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় একটি পর্যটকবাহী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার গভীর পানিতে ডুবে যায়। এ দুর্ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্যের পুরো পরিবারসহ বিভিন্ন বয়সের ৯ নারী-পুরুষের মৃত্যু হয়। যুগান্তরের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রতিদিন একেকটি বাল্কহেড থেকে ৬০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা নেওয়া হয় বলে ক্ষোভ ঝাড়েন বাংলাদেশ বাল্কহেড নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন।
নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের জন্য ১৫ ধরনের নৌযানের অনুমতি রয়েছে। অভ্যন্তীণ রুটে সারা দেশে সব মিলে ১৬ হাজার ৯৮০টি অনুমোদিত নৌযান চলাচল করে। এর মধ্যে অনুমোদিত নৌযান বাল্কহেডের সংখ্যা ৭ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে রুট পারমিট আছে ৩২০০টি বাল্কহেডের। সেখান থেকে অনুমোদন ও নিবন্ধনহীন বাল্কহেডের সংখ্যা না জানা গেলেও বাংলাদেশ বাল্কহেড নৌযান মালিক সমিতির তথ্যমতে অনুমোদন ও নিবন্ধনহীন বাল্কহেডের সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি। আর এসব বাল্কহেডের অধিকাংশই ঢাক-নারায়ণগঞ্জ (ভায়া ভৈরব) সিলেট রুট হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বালু, পাথর ও কয়লা পরিবহণের কাজে নিয়োজিত থাকে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমার ও জাহাজের যাত্রা নিরাপদ করতে রাতে যাত্রীবাহী নৌরুটে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তবে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী লঞ্চচালক মাস্টার-সুকানি ও ট্রলারচালকরা।
বাংলাদেশ বাল্কহেড নৌযান মালিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক তোফাজ্জল হোসেন বুধবার অভিযোগ করেন, একেকটি বাল্কহেডের মালামাল পরিবহণের জন্য নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ডের লোকজনকে ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুস ও চাঁদা দিতে হয়। আর এসব কারণে বাল্কহেড অনিবন্ধিত ও অনুমোদনহীন রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন একশ্রেণির মালিকরা। এছাড়া অনুমোদন ও নিবন্ধনহীন বাল্কহেডগুলোই নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ডদের বেশি সেবা পেয়ে থাকে। তার মতে, দেশে ৭ হাজার ৫০০টি অনুমোদন ও নিবন্ধনপ্রাপ্ত বাল্কহেডের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে অন্তত আরও সাড়ে ৩ হাজার অনুমোদন ও নিবন্ধনহীন বাল্কহেড একই সঙ্গে চলাচল করছে। তিনি আরও জানান, ঘাটে ঘাটে নৌপুলিশ ও কোস্ট গার্ডদের এমন চাঁদাবাজির চিত্র তুলে ধরে সংগঠনের প্যাডে নৌপরিবহণ অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বরাবর একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করা হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বুধবার দুপুরে বিআইডব্লিউটিএর নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনুমোদন ও নিবন্ধনপ্রাপ্ত বাল্কহেডের সংখ্যা নিশ্চিত করেন। তবে অনুমোদন ও নিবন্ধনহীন বাল্কহেডের সংখ্যা এবং ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি ও প্রতিকারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান। এসব বিষয়ে মিটিং শেষে কথা বলছি বলে ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
মেঘনায় অভিযান, আটক ৯ : চাঁদপুর প্রতিনিধি জানান, চাঁদপুরে মেঘনা নদীতে বালুবাহী অবৈধ বাল্কহেড চলাচল বন্ধে অভিযান চালিয়ে বুধবার ৯ সুকানি ও শ্রমিককে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় সার্ভে সনদ ঝুলিয়ে না রাখা, রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রকাশ্যে স্থানে সংযুক্ত না রাখা ও সুকানি যোগ্যতা সনদ না থাকা বাল্কহেড কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযান পরিচালনা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. বেলায়েত হোসেন শিকদার। আটক সুকানি ও শ্রমিকরা হলেন সুকানি হুমায়ুন কবির, শ্রমিক আবু ছালেক, আক্তার হোসেন, মোস্তফা মিয়া, শাকিল আহমেদ, মো. কৈশব, শফিকুল ইসলাম, মো. মহিউদ্দিন ও নাছির উদ্দিন। ওসি কামরুজ্জামান বলেন, ‘আটক সুকানি ও শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারায় আদালতে পাঠানো হয়েছে।
ঈদে ১১ দিন বন্ধ থাকবে বাল্কহেড : এবার ঈদের আগে-পরে ১১ দিন নৌপথে সব ধরনের বাল্কহেড চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে। এছাড়াও শুধু রাতের বেলা স্পিডবোট বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে নৌ পুলিশ। বুধবার দুপুরে পুলিশ প্লাজায় ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে নৌপথের আইনশৃঙ্খলা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মতবিনিময় সভায় এ কথা জানান নৌ-পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহা. আবদুল আলীম মাহমুদ। তিনি বলেন, ঈদে ঘরমুখো নৌ-যাত্রীদের নিরাপত্তা নির্বিঘ্ন রাখতে নৌ পুলিশ বদ্ধপরিকর। নৌ পুলিশ সব নৌ ঘাট, নৌ টার্মিনালে দায়িত্ব পালন করবে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গ্রামে যায়, আর আমরা ঈদের আনন্দ বিসর্জন দেই। নৌ-পুলিশ জন্ম থেকেই এই কাজটি করে যাচ্ছে। আশা করছি, আমাদের এই বিসর্জন ঈদ আনন্দ আরও বেশি সুন্দর করে তুলবে।