Logo
Logo
×

সারাদেশ

শিক্ষক রায়হান বদমেজাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করায় কয়েকবার বরখাস্ত হন

Icon

জেহাদুল ইসলাম, সিরাজগঞ্জ

প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৪, ১০:৫৫ পিএম

শিক্ষক রায়হান বদমেজাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করায় কয়েকবার বরখাস্ত হন

কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. রায়হান শরীফ সিরাজগঞ্জ শহিদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের চাকরিতে যোগদানের পূর্বে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। এসব প্রতিষ্ঠানে তিনি রাগী ও বদমেজাজি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

কারণে-অকারণে তিনি তার সহকর্মী, শিক্ষার্থীসহ অন্যদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতেন। পান থেকে চুন খসলেই তিনি অস্ত্র প্রদর্শন করে নিজেকে জাহির করতেন। সে কারণে পূর্বের কর্মস্থল থেকে তিনি বরখাস্তও হয়েছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশজুড়ে আলোচিত শহিদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আরিফিন আমিন তমালকে গুলি করে আহত করা শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের পৈতৃক বাড়ি সিরাজগঞ্জ শহরের কলেজ রোডের প্রফেসর গার্ডেনে। বাবা মো. আব্দুর রাজ্জাক সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ। তিনি ২০১৪ সালে অবসরে যান। মা শাহিন পারভীন সিরাজগঞ্জে স্বাস্থ্য বিভাগে স্বাস্থ্য সহকারী পদে চাকরি করেন।

ডা. রায়হান শরিফরা দুই ভাই-বোন। তিনি বাবা-মার বড় সন্তান। তিনি সিরাজগঞ্জ থেকে ২০০৭ সালে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে এইচএসসি পাস করেন। ২০১০-২০১১ শিক্ষাবর্ষে তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ২০১৩ সালে থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৬ সালে এমবিবিএস পাশ করে সিরাজগঞ্জ নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু বিভাগে মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন ডা. রায়হান শরিফ। এখানে তিনি প্রভাব বিস্তার করতে কারণে অকারণে তার সহকর্মীসহ অন্যদের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করতেন। নিজেকে জাহির করতে প্রকাশ্যে বের করতেন আগ্নেয়াস্ত্র। তার এমন উচ্ছৃঙ্খল আচরণের কারণে চাকরিতে যোগদানের কয়েক মাসের মাথায় কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন। এমন তথ্য জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই হাসপাতালের একাধিক কর্মচারী।

পরে ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষায় পাশ করে ২০২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ১৬ মার্চ পর্যন্ত রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একজন কর্মচারী জানান, রায়হান শরীফ স্যার খুব কম কথা বলতেন। সব সময় তাকে রাগি মনে হতো। তবে এখানে চাকরি করাকালীন তার নামে কারো কোনো অভিযোগ ছিল কি-না তা আমার জানা নেই।

২০২৩ সালের ২২ মার্চ তিনি সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানকার শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- ডা. রায়হান শরীফ অত্যন্ত বদমেজাজি ও কুরুচি সম্পন্ন মানুষ। কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক হলেও তিনি প্রভাব খাটিয়ে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতেন। তার কথামতো না চললে শিক্ষার্থীদের ভাইভাতে ফেল করানোর ভয় দেখাতেন। ছাত্রীদের উত্যক্ত করতেন। গভীর রাতে মোবাইল করে অশালীন কথাবার্তা বলতেন। নিজেকে জাহির করতে মাঝে মধ্যেই পিস্তল বের করে শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখাতেন। তার এমন আচরণে অতিষ্ঠ শিক্ষার্থীরা কয়েক দফা মৌখিক অভিযোগ দিলেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

এরই ধারাবাহিকতায় সোমবার বিকেলে অসময়ে অতিরিক্ত ক্লাস করা নিয়ে বিতর্কের জেরে কলেজের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে গুলি করে আহত করেন শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফ। এমন অভিযোগ ওই কলেজের শিক্ষার্থীদের।

এ ঘটনার পর বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককে শ্রেণিকক্ষে আটকে রেখে ডা. রায়হান শরীফকে চাকুরী থেকে বহিষ্কার ও দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ করে। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করে এবং অভিযুক্ত শিক্ষককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়।

এ সময় ওই শিক্ষকের ব্যাগে থানা দুটি অত্যাধুনিক বিদেশি পিস্তল, ৮১ রাউন্ড গুলি, চারটি ম্যাগজিন ও ১২টি বিদেশি চাকু উদ্ধার করে পুলিশ। ওই রাতেই আহত কলেজ ছাত্র আরাফাত আমিন তমালের বাবা আব্দুল্লাহ আল আমিন তার ছেলেকে হত্যাচেষ্টা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। অস্ত্র আইনে অপর একটি মামলা করেন ডিবির এসআই আব্দুল ওয়াদুদ।

এর আগে মঙ্গলবার সকালে মেডিকেল কলেজের সামনের সিরাজগঞ্জ-হাটিকুমরুল সংযোগ মহাসড়ক অবরোধ করে অভিযুক্ত শিক্ষককে বরখাস্ত ও দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা।

পরে সিরাজগঞ্জ সদর-কামারখন্দ আসনের এমপি জান্নাত আরা হেনরী ও কলেজ অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে তার ক্যাম্পাসে ফিরে যায়। তবে দ্রুত দাবি পূরণ না হলে পরবর্তীতে বৃহত্তর আন্দোলনের হুশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।

এদিকে সোমবার স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজকে আহবায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক মো. মহিউদ্দিন মাতুব্বর এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের উপ-সচিব মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার সিরাজগঞ্জ পৌঁছে মেডিকেল কলেজ থেকে তাদের তদন্ত কাজ শুরু করেন।

এ সময় থানায় গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ডা. রায়হান শরীফ তদন্ত কমিটির কাছে তার দোষ স্বীকার করেন। তবে ঘটনাটি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। বিষয়টি নিশ্চিত করেন মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী।

এছাড়াও সন্ধ্যায় আদালতে হাজির করা হলে শিক্ষক রায়হান শরীফ ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ সময় আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

অপরদিকে অভিযুক্ত শিক্ষক ডা. রায়হান শরীফের শাস্তি দাবি করে বুধবার ক্লাস বর্জন করে শিক্ষার্থীরা। কলেজ অধ্যক্ষ জানান, দুপুর ১টার দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসেছিলাম। তাদেরকে বুঝিয়েছি যে- ক্লাস না করলে তাদেরই পড়াশোনার ক্ষতি হবে। এছাড়া অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে বললে তারা বৃহস্পতিবার থেকে নিয়মিত ক্লাস করার প্রতিশ্রুতি দেয়।

অপরদিকে বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দূর-রে শাহওয়াজ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে শিক্ষক রায়হান শরীফকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে- শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. মো. রায়হান শরীফ ফৌজদারি অপরাধে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। সাময়িক বরখাস্তকালীন তিনি বিধিমোতাবেক খোরপোষ ভাতা প্রাপ্ত হবেন। জনস্বার্থে এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে। সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আমিরুল হোসেন চৌধুরী সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অধ্যক্ষ ডা. আমিরুল হোসেন চৌধুরী বলেন, ওই শিক্ষক মাঝে মধ্যেই ক্যাম্পাসে অস্ত্র প্রদর্শন করতেন এমন অভিযোগ কেউ কখনো দেয়নি। দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম