৮ দিনের মাথায় পদ্মার তলদেশ থেকে উঠল ফেরি রজনীগন্ধা
যুগান্তর প্রতিবেদন, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:১১ পিএম
অবশেষে টানা আট দিনের মাথায় পদ্মা নদীতে ৯টি ট্রাকসহ ডুবে যাওয়া ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা উদ্ধার হয়েছে। বুধবার রাত ১১টার দিকে ফেরিটি উদ্ধার করে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়।
বুধবার রাত ১০টার দিকে ডুবে যাওয়া ফেরিটি সম্পূর্ণরূপে পদ্মার পানির ওপর ভাসিয়ে তোলা হয়। পরে রাত ১১টার দিকে ফেরিটি ভাসিয়ে পাটুরিয়া ঘাটের ভাটিতে নয়াকান্দি এলাকার পদ্মার তীরে নিয়ে রাখা হয়।
বিআইডব্লিউটিএ, ফায়ার সার্ভিস ও বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ডুবুরি দল ও উদ্ধার কর্মীদের যৌথ প্রচেষ্টায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে এই ফেরি উদ্ধারের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজটি করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধার কার্যক্রমের ইউনিটপ্রধান বিআইডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (নৌপথ) আব্দুস সালাম।
আরও পড়ুন: সাত দিনের চেষ্টায় দৃশ্যমান পদ্মায় ডুবে যাওয়া ইউটিলিটি ফেরি রজনীগন্ধা
ফেরিডুবির পর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. একেএম মতিউর রহমান নিজেই আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন ফেরিটি সরকারের উদ্ধারকারী জাহাজ দিয়ে উদ্ধার সম্ভব নাও হতে পারে। সেই চ্যালেঞ্জের মুখে একে একে পৃথক তিনটি উদ্ধারকারী জাহাজ দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন কৌশল খাঁটিয়ে অবশেষে আট দিনের মাথায় ফেরিটি উঠানো সম্ভব হয়েছে।
ফেরিটি উদ্ধার কার্যক্রমে অপ্রত্যাশিত নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বলে জানান বিআডব্লিউটিএর অতিরিক্ত পরিচালক (নৌপথ) মো. আব্দুস সালাম। নানান ঝক্কিঝামেলা নিয়ে অবশেষে বুধবার রাতে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ দিয়ে ফেরিটিকে টেনে ভাসিয়ে নদীর তীরে নেওয়া সম্ভব হয়েছে।
আরও পড়ুন: তলদেশ ফুটো হয়ে পদ্মায় ডুবে যায় রজনীগন্ধা: বিআইডব্লিউটিসি চেয়ারম্যান
ফেরি উদ্ধার নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডুবে যাওয়ার পর ফেরিটি উল্টে যায়। তীব্র স্রোতে ফেরিটি নদীর তলদেশে পলিমাটি পড়ে আটকে যায়। এতে ২৪০ টন ওজনের ফেরিটির ওজন ৩০০ টন ছাড়িয়ে যায়। ফলে উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম দিয়ে ফেরিটিকে উঠানো সম্ভব হয়নি। কারণ এ দুটি উদ্ধারকারী জাহাজের ৮০ থেকে ৯০ টন ওজনের বস্তুকে ওঠানোর সক্ষমতা রয়েছে।
পরবর্তীতে গত শুক্রবার দুপুরে বিআইডব্লিউটিএর সব থেকে শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়কে দুর্ঘটনাস্থলে আনা হয়। তবে এর সক্ষমতা ২৫০ টন হওয়ায় ফেরিটিকে উদ্ধারে এই শক্তিশালী জাহাজটিও ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিআডব্লিউটিএ ও ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল যৌথভাবে এ উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়। এরপর ডুবে থাকা ফেরির ভেতরে এয়ার লিফটিং ব্যাগ স্থাপন করে ফেরিটিকে হালকা করে নদীর তলদেশে থেকে উপরে ওঠানোর কার্যক্রম শুরু হয়। তবে ফেরির তলায় ফাটলের সৃষ্টি হওয়ায় এই উদ্যোগ সফল হওয়া যায়নি।
এদিকে নদীতে প্রচণ্ড স্রোত ও প্রচণ্ড শীতের কারণে উদ্ধারকারী দলের সদস্যদের উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত হয়। নদীর তলদেশে দেখতে না পাওয়ায় ডুবে থাকা ফেরি ওয়্যার লিফটিং ব্যাগ স্থাপনে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এতে উদ্ধার কার্যক্রমে সময় বেশি লাগে।
পরবর্তীতে গত রোববার বিকেলে উদ্ধারকাজে যুক্ত হতে নারায়ণগঞ্জ থেকে অনুসন্ধানী জাহাজ ঝিনাই-১ ঘটনাস্থলে আনা হয়। পরের দিন এ জাহাজ দিয়ে নদীর তলদেশে ফেরিটির সঠিক অবস্থান নির্ণয় সহজ হয়। এরপর ডুবুরিরা ফেরিতে এয়ার লিফটিং ব্যাগ স্থাপন করে পাম্প যন্ত্রের মাধ্যমে বাতাস দিতে থাকে। এ উদ্ধার অভিযানে নৌবাহিনী ও বিআইডব্লিউটিএর উদ্ধারকারী দল অংশ নেয়।
একপর্যায়ে গত সোমবার বিকালে ফেরিটি এক পাশ কিছুটা হালকা হয়। এরপর উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়ের ওয়্যার রোপ (মোটা তার) দিয়ে ফেরিটির একপাশে বাঁধা (হুক দিয়ে আটকানো) হয়। এরপর প্রত্যয়ের ক্রেন দিয়ে ফেরিটির একপাশ ধীরে ধীরে উঠানোর চেষ্টা করা হয়। পরে নদীর তলদেশ থেকে ফেরিটির একপাশ সামান্য উঁচু করে রাখা হয়। এরপর পাম্পিংয়ের মাধ্যমে ফেরির ভেতরে থাকা পলিমাটি অপসারণের কাজ শুরু হয়।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) শাহ মোহাম্মদ খালেদ নেওয়াজ বলেন, বুধবার রাত ১১টার দিকে ফেরিটি তীরে ভেড়ানো সম্ভব হয়েছে। ফেরিকে এখন নদীর পাড়ে এনে রাখা হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে ওই এলাকায় ফেরিটির ধোয়া-মোছার কাজ চলছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা।
ফেরি রজনীগন্ধা উদ্ধারে নৌবাহিনীর ডুবুরি দলের প্রধান লে. শাহ পরাণ ইমন বলেন, নদীতে প্রচণ্ড স্রোত, কুয়াশা ও কনকনে শীতের কারণে উদ্ধার অভিযান কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায় ফেরিটি তুলতে বিলম্ব হয়। অবশেষে নানান পরিস্থিতি মোকাবেলার পর টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে ফেরিটিকে নদীর তলদেশ থেকে উপরে ওঠানো সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১৭ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ৯টি ট্রাকসহ ফেরিটি ডুবে যায়। উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা ২০ জনকে উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় নিখোঁজ ছিলেন ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিন মাস্টার হুমায়ুন কবির (৪৫)। গত সোমবার বিকালে দুর্ঘটনাস্থলের প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে হরিরামপুর উপজেলার বাহাদুরপুর এলাকায় পদ্মা নদী থেকে তার লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল। অষ্টম দিনে আরও একটি ট্রাকসহ মোট ৯টি ট্রাক উদ্ধার হয়েছে।