গ্যাসের চাপ নেই, গাজীপুরে শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে
গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:০২ পিএম
গ্যাস সংকটের উন্নতি না হওয়ায় গাজীপুরে শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সময়মতো অর্ডার সরবরাহ। কারখানা কর্তৃপক্ষ বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। শ্রমিকদের বসিয়ে রেখে বেতনভাতা দিতে হচ্ছে। এতে শিল্পমালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পথে।
জানা যায়, গাজীপুরে ছোট-বড় পাঁচ হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানা, কলকারখানা রয়েছে। আর এর বেশির ভাগই গ্যাসনির্ভর। এক থেকে দেড় মাস এসব কলকারখানায় গ্যাস সংকট চলছে। বায়ার (ক্রেতা) ধরে রাখতে অনেকে ভর্তুকি দিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় কারখানা চালু রাখলেও বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকটে শ্রমিকরা ঠিকমতো শিডিউল মেলাতে পারছেন না। অনাহারে-অর্ধাহারে শ্রমিকরা কারখানায় এলেও গ্যাসের চাপ না থাকায় তাদের বেকার সময় পার করতে হচ্ছে। এ সংকটের সমাধান না হলে শতভাগ রপ্তানিমুখী শত শত পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
শনিবার গাজীপুরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, সফিপুর, চন্দ্রা, সদরের কাউলতিয়া, মির্জাপুর, বাহাদুরপুর, ভবানীপুর, পিরোজালী, বাংলাবাজার, শ্রীপুরের সদর, রাজাবাড়ী, বাঘের বাজার, জরিনাবাজার, মাওনা এবং এর আশপাশের এলাকায় গ্যাসের তীব্র সংকট ছিল। গ্যাসের চাপ খুব কম থাকায় সিএনজি স্টেশনগুলোয়ও গাড়ির দীর্ঘ লাইন দেখা গেছে। কালিয়াকৈর উপজেলার মৌচাক এলাকার পোশাক কারখানা সাদমা ফ্যাশন লিমিটেডে ছয় মাস ধরে গ্যাসের চাপ নেই। জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে সেই বিদ্যুৎ দিয়ে পোশাক কারখানার সব কাজ করা হয়। ডাইং ইউনিটটি গ্যাস দিয়ে চলে। গ্যাসের চাপ কমবেশি হওয়ায় অনেক সময়ই ডাইং মেশিনগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে। অনেক সময় লাইনে গ্যাস থাকেও না। ফলে কারখানাটির উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এমএম নিট ওয়্যার লিমিটেড কারখানার ডিজিএম মনোয়ার হোসেন বলেন, পোশাক সেলাই করেছি। কিন্তু ফিনিশিং করতে পারছি না। অথচ নানা ধরনের ব্যয় হচ্ছে। আমাদের উৎপাদন ২৫-৩০ ভাগ কমে গেছে। কারখানার শ্রমিকরা যুগান্তরকে বলেন, গ্যাস সমস্যায় একটা কাজ ১২ ঘণ্টার পরিবর্তে আমাদের ১৫-১৬ ঘণ্টায় করতে হচ্ছে। ২৬ টন উৎপাদনের জায়গায় মাত্র সাড়ে ১১ টন হচ্ছে। ভোর ৩টা-৪টায় গ্যাসের চাপ একটু বাড়লেও মাত্র ১-২ ঘণ্টা থাকে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কোনাবাড়ী শিল্পাঞ্চল (বিসিক) এলাকার লাইফ টেক্সাইল (প্রাইভেট) লিমিটেড ও সফিপুর এলাকার ময়জউদ্দিন টেক্সটাইল লিমিটেডের পার্সোনাল অফিসার এমডি হাসান বলেন, শুক্রবার গ্যাসের চাপ একটু ভালো থাকলেও শনিবার থেকে কমতে থাকে। সপ্তাহের অন্যসব দিন গ্যাসের চাপ একেবারেই থাকে না। অনেক সময় তা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। তখন মেশিন বন্ধ করে শ্রমিকদের বসিয়ে রাখতে হয়। শ্রমিকদের এভাবে বসিয়ে রেখে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এভাবে এক-দেড় মাস গ্যাস সংকট চলছে। অথচ মাস গেলেই গ্যাস বিল আসছে কোটি টাকার ওপরে, শ্রমিকের বেতনভাতাও প্রায় ১১ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে।
কোনাবাড়ী এলাকার শতভাগ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা তুসুকা ডেনিম লিমিটেডে ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। এ কারখানার এমডি বাবুল যুগান্তরকে বলেন, গ্যাসের চাপ খুব কম থাকলে শ্রমিকদের বসিয়ে রাখতে হয়। এতে শিডিউল বিপর্যয় হচ্ছে। অনেক সময় অর্ডার সরবরাহ দেওয়ার স্বার্থে কয়েকগুণ খরচে ডিজেলের মাধ্যমে মেশিন চালু রাখতে হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
কালিয়াকৈর উপজেলার সফিপুর, চন্দ্রা ও পল্লীবিদ্যুৎ এলাকায় কয়েক মাস ধরে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে সহস্রাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। এসব এলাকায় গ্যাসের চাপ নেই বললেই চলে। তাই ডাইং মেশিন ও জেনারেটর চালু রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ডাইং কারখানায় উৎপাদনের মান নিুমানের হওয়ায় লোকসানের মুখে পড়ছে মালিকপক্ষ। ওই এলাকায় পোশাক তৈরির সাড়ে চার শতাধিক কারখানার মধ্যে সুতা তৈরির প্রায় দুই শতাধিক কারখানা ও ডাইং কারখানা রয়েছে। কয়েক মাস ধরে লাইনে গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন কমেছে অর্ধেকে। কারখানাগুলোর মধ্যে সামছুউদ্দিন স্পিনিং মিলস, মালেক স্পিনিং মিলস, এসএ স্পিনিং মিলস লিমিটেড, হানিফ স্পিনিং মিলস, স্টারলিং ফ্যাশন লিমিটেড, গোমতি টেক্সটাইল লিমিটেড মিলসহ অর্ধশতাধিক সুতা তৈরির কারখানা রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বাসাবাড়িতে বেশ কিছুদিন ধরে গ্যাসের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এতে রান্নার কাজে ব্যাঘাত ঘটায় এলাকাবাসীও চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন।
কারখানার মালিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কারখানার বয়লার চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকার কথা থাকলেও সেখানে গ্যাসের চাপ কমে আসে প্রতি ঘনফুটে ১ থেকে ২ পিএসআইতে। শুক্র ও শনিবার জেলার অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ৬-৭ পিএসআই গ্যাসের চাপ পাওয়া যায়। সফিপুর আনসার একাডেমির এলাকার গোমতি টেক্সাটাইলে গিয়ে জানা যায়, গ্যাসের চাপ কম থাকায় উৎপাদন ৫০ ভাগ কম হয়েছে। গ্যাস সংকটের আগে প্রতি ইউনিট গ্যাস ১১টাকা দরে কেনা হতো। এখন সাড়ে ২৭ টাকা দিয়েও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না। কারখানার জেনারেল ম্যানেজার আনোয়ার হোসাইন বলেন, কারখানায় প্রতিদিন গ্যাসের ৭ পিএসআই চাপ প্রয়োজন। কিন্তু সেখানে মাত্র ১ থেকে দেড় পিএসআই গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সময়মতো তারা পোশাক সরবরাহ করতে পারছেন না। ক্রেতারা পরিবহণ খরচ বহন না করায় কোম্পানির চারগুণ খরচে অতিরিক্ত বিমান ভাড়া দিয়ে পোশাক পাঠাতে হচ্ছে।
এপেক্স ফুটওয়ার (জুতা ফ্যাক্টরি) কারখানায় দুই শিফটে সাড়ে পাঁচ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। সেখানে প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে। নিজস্ব জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করে কাজ করাতে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। গ্যাসচালিত জেনারেটর ডিজেল দিয়ে চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ ১০-১৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। কারখানার মানবসম্পদ কর্মকর্তা ইমরান হোসেন জানান, বিদ্যুতের ঘনঘন লোডশেডিংয়ে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সফিপুর আনসার একাডেমি এলাকার স্টারলিং পোশাক তৈরির কারখানার মানবসম্পদ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা গ্যাস দিয়ে নিজস্ব জেনারেটর চালাই। গ্যাসের চাপ না থাকলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। কালিয়াকৈর পূর্ব চান্দরা বোর্ড মিল এলাকার লিজ ফ্যাশন ও লিডা টেক্সটাইল কারখানার জিএম জাহাঙ্গীর আলম জয় জানান, দুটি কারখানায় ১৯ হাজার শ্রমিক রয়েছে। বেশির ভাগ সময় গ্যাসের চাপ কম থাকায় কারখানার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। গ্যাসের চাপ কম থাকায় চাহিদামতো উৎপাদন হচ্ছে না।
বিজিএমইএ-এর সহসভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে। তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির চন্দ্রা জোনের সহকারী প্রকৌশলী মাসুদ বিন ইউসুফ বলেন, চাহিদামতো গ্যাস পাওয়া যায় না। ২০ জানুয়ারির পর থেকে গ্যাস স্বাভাবিক হওয়ার কথা ছিল। আশা করছি, সংকট কেটে যাবে।