মা-বাবার কোলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে ফ্রান্স থেকে চরফ্যাশনে
চরফ্যাশন (ভোলা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৯ পিএম
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মো. ইব্রাহীম; যার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা অর্জন শেষে বড় চাকরি করে দাঁড়াবেন পরিবারের পাশে, আর সেই আশায় ফ্রান্সে যাওয়া। ছেলের স্বপ্নপূরণে পরিবারও বাধা দেয়নি। ছেলের ইচ্ছাপূরণে এনজিও ও স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা ধার-দেনা করে ফ্রান্সে পাঠান মা-বাবা। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যানসার নিঃশেষ করে দিয়েছে ইব্রাহীমের সব স্বপ্ন।
শেষ নিঃশ্বাস নিজের দেশে ত্যাগ করবেন বলে আবদার করলেও তাকে দেশে নিয়ে আসার মতো ছিল না কেউ। এমন সময় মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে ইব্রাহীমকে দেশে নিয়ে আসেন ফ্রান্সের চিকিৎসক ডা. ম্যাথিউ জামেলট।
জানা গেছে, উপজেলার হাজারীগঞ্জ ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের হাজারীগঞ্জ গ্রামের হাওলাদার বাড়ির মো. কাঞ্চন হাওলাদারের ছেলে ইব্রাহীম। উচ্চশিক্ষার জন্য পরিবারের কাছে ফ্রান্সে যাওয়ার আবদার করেন।
তার সেই আবদার পূরণ করতে পরিবার ধার-দেনা করে ২০২২ সালের শুরুর দিকে ইব্রাহীমকে ফ্রান্সে পাঠান; কিন্তু যাওয়ার মাত্র ৭ মাসের মধ্যেই ইব্রাহীম আক্রান্ত হন মরণব্যাধি ক্যান্সারে।
ইব্রাহীম জানান, অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বেশ কয়েক মাস ক্লাসও করেছেন; কিন্তু ফ্রান্সে যাওয়ার পাঁচ মাস পর তার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে তিনি ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খান। কিছুতেই কমছিল না ব্যথা। পরে আরও দুই মাসের মাথায় টেস্টে ধরা পড়ে তার লিভার ক্যান্সার। এরপর তিনি ফ্রান্সের ড. ম্যাথিউ জামেলটের অধীনে প্রায় এক বছর চিকিৎসা নিয়েছেন; কিন্তু কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না। দিন দিন তার শরীরের অবনতি হতে থাকে। চিকিৎসকও তার হাল ছেড়ে দেন। তাকে সরাসরি বলেই দেন তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।
এমন অবস্থায় অসুস্থ হয়ে তিনি সারা দিন তার গ্রামের বাড়ি, বাবা-মা এবং আত্মীয়-স্বজনদের কথা ভাবতেন। এরপর তিনি ওই চিকিৎসকে বলেন, ‘শেষ নিঃশ্বাস তিনি তার বাবা-মার কোলে ত্যাগ করতে চান।’ কিন্তু তাকে দেশে নিয়ে আসার মতো ছিল না কেউ। পরে ওই চিকিৎসক তাকে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিজে গত ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে তার পরিবারের কাছে দিয়ে যান। শুক্রবার তিনি গ্রামের বাড়ি হাজারীগঞ্জ বাবার বাড়িতে আসেন।
ফরাসি চিকিৎসক ম্যাথিউ জামেলটের এমন কাজের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যতদিন বাঁচবেন তার জন্য দোয়া করবেন বলে জানান ইব্রাহীম।
ইব্রাহীমের সহপাঠী মো. মামুন বলেন, তিনি ইব্রাহীমের সঙ্গে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই পড়াশোনা করেন। ইব্রাহীম যখন উচ্চশিক্ষার জন্য ফ্রান্সে যায় তখন আমরা বন্ধুরা সবাই অনেক খুশি হয়েছিলাম। ইব্রাহীমকে আমরা ১৫-২০ জন বন্ধু মিলে ঢাকায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়েছিলাম। সে ফ্রান্সে গিয়েও আমাদের ফোন দিত; কিন্তু হঠাৎ করে ইব্রাহীমের ক্যান্সারে আক্রান্তের খবর শুনে আমাদের বন্ধুমহলে হতাশা নেমে এসেছে। শুক্রবার ইব্রাহীম গ্রামের বাড়িতে আসার পর থেকে আমরা প্রতিদিনই সকাল বিকাল তাদের বাড়িতে যাচ্ছি। আর তাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছি।
ইব্রাহীমের বাবা মো. কাঞ্চন হাওলাদার ও বড় বোন লিলু বেগম জানান, ছেলের ইচ্ছাপূরণে ধার-দেনা করে ইব্রাহীমকে ফ্রান্সে পাঠাই। আশা ছিল ইব্রাহীম বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা অর্জন করে বড় চাকরি করে সব দেনা পরিশোধ করবে ও আমাদের পাশে দাঁড়াবে। কিন্তু আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। ইব্রাহীমকে আর বাঁচাতে পারব না এটা ভেবেই আর কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। আর ধার-দেনা কিভাবে পরিশোধ করব জানি না। যদি ফ্রান্স সরকার ও বাংলাদেশ সরকার আমাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে আমরা আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারব।
জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানান, ইব্রাহীমের
ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তবে ইব্রাহীমের পরিবার থেকে চিকিৎসার জন্য আবেদন করলে তারা সরকারিভাবে সহযোগিতা করবেন।