চোখের সামনে ট্রেনের আগুনে পুড়ছিল বোন-ভাগ্নে, বাকরুদ্ধ হাবিব
নেত্রকোনা প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৪৪ পিএম
চোখের সামনেই জ্বলছিল বোন আর ভাগ্নে। চোখের সামনেই বোন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও ভাগনে ইয়াছিন আরাফাতকে (৩) পুড়ে মরতে দেখেন বাকরুদ্ধ হাবিব।
ভোরের দিকে ট্রেনে হঠাৎ করে আগুন দেখে বড় ভাগনে ফাহিম আহমেদকে (৬) নিয়ে নিচে ঝাঁপ দেন হাবিব। বোনকেও পেছনে নামার কথা বলে আত্মরক্ষার্থে নেমে পড়েন তিনি। মুহূর্তেই পেছনে ফিরে দেখেন বোন আর ছোট ভাগনে আটকে পড়েছে ট্রেনে। এরপরও বোন-ভাগ্নেকে উদ্ধার করতে চেয়েছিল হাবিব কিন্তু উপস্থিত লোকজনের জন্য পারেননি তিনি।
যুগান্তরকে মোবাইল ফোনে এভাবেই বলছিলেন হাবিবুর রহমান হাবিব।
দুই ভাগনে আর বোনকে নিয়ে ট্রেনে করে সোমবার রাতে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন হাবিব। নাদিরার বাড়ি নেত্রকোনা সদরের দক্ষিণ বিশিউড়া ইউনিয়নের বরুনা গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মিজানুর রহমানের স্ত্রী। তার স্বামী মিজান ঢাকার কারওয়ানবাজারে হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন। তিনি ভাই এবং দুই সন্তানকে নিয়ে সোমবার রাতে ট্রেনে করে নেত্রকোনা থেকে স্বামীর কর্মস্থলে ফিরছিলেন। এ সময় তারা মোট নয়জন ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এর আগের স্টেশনে ৫ জন নেমে যান।
নেত্রকোনা থেকে ছেড়ে যাওয়া মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মা-ছেলেসহ ৪ জনের মরদেহ মঙ্গলবার ভোরে উদ্ধার করে পুলিশ।
মঙ্গলবার ভোর আনুমানিক ৫টায় তেজগাঁও স্টেশনে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে দুজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহতরা হলেন- নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার ছেলে ইয়াছিন আরাফাত (৩)। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি।
নিহত নাদিরার ভাই হাবিবুর রহমান আরও জানান, ঢাকার তেজগাঁও তেজতুরীবাজার এলাকায় তারা থাকেন। নাদিরার স্বামী মিজানুর হার্ডওয়্যারের ব্যবসা করেন। গত ৩ ডিসেম্বর তারা বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নেত্রকোনার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই সোমবার রাত ১২টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে করে নেত্রকোনা বড় স্টেশন থেকে ঢাকায় ফিরতে রওনা দিয়েছিলেন। ভোরে তাদের ঢাকায় পৌঁছার কথা ছিল।
হাবিবুর জানান, বিমানবন্দর স্টেশন এসে ট্রেনটি থামলে তাদের পাঁচ যাত্রী সেখানে নেমে যায়। এ সময় তাদের পেছনের ছিটে থাকা দুই ব্যক্তিও নেমে যান। এরপর ট্রেনটা চলতে শুরু করা মাত্রই পেছনের সিট থেকে আগুন জ্বলে উঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে দৌড়ে তিনি ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে পারলেও ভেতরে আটকা পড়েন ছোট ইয়াছিন ও তার মা নাদিরা। তাদের আর কোনোভাবেই বের করতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস তাদের মরদেহ বের করে।
জেলার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা নাদিরার বাবা ফজল হক যুগান্তরকে বলেন, আমার মেয়ে ও নাতিকে কেন মারা হলো? কী অপরাধ আমার সন্তানের? কার জন্য আমার এই ক্ষতি করা হলো? এর বিচার কে করবে? কার কাছে আমি বিচার চাইব। তিন বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে আগুনে পুড়িয়ে কেন হত্যা করা হলো? আমি এর বিচার চাই আল্লাহর কাছে।
নাদিরার শাশুড়ি মেহেরুন নেসা ও চাচাশ্বশুর আব্দুল কাদির মিলন বলেন, আমরা এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন বলেন, ট্রেনটি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ঢাকার কমলাপুরে আসছিল। বিমানবন্দর স্টেশন পার হওয়ার পর খিলক্ষেত এলাকায় পৌঁছলে যাত্রীরা পেছনের বগিতে আগুন দেখতে পান। পরে তারা চিৎকার করতে শুরু করেন। এরপর চালক ট্রেনটি তেজগাঁও স্টেশনে থামান।
নেত্রকোনার পুলিশ সুপার মো. ফয়েজ আহমেদ নিহতের স্বজনদের বরাত দিয়ে বিকাল ৩টার দিকে যুগান্তরকে বলেন, এ ঘটনায় মোট তিন ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। নিহতদের মরদেহ নেত্রকোনার উদ্দেশে নিয়ে আসার জন্য রওনা দিয়েছেন।