লৌহজংয়ে রাসেল ভাইপার আতঙ্কে পদ্মা পারের মানুষ
শেখ সাইদুর রহমান টুটুল, লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ)
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৩, ১০:৫১ পিএম
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপের আতঙ্কে রয়েছে পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসবাস করা মানুষ। একের পর এক বিষাক্ত রাসেল ভাইপার সাপের দেখা মিলছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়।
১ নভেম্বর উপজেলার বেজগাঁও গ্রামের মোসলেম শেখের ছেলে বাবু শেখ (২৮) নামের এক যুবক বিষধর রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ের শিকার হন। ওই দিন সন্ধ্যায় পদ্মাপাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যায় বাবু শেখ। বাড়ি ফেরার পথে উপজেলার বেজগাঁও-গাওদিয়া সড়কে হঠাৎ সাপে দংশন করে তাকে। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে সেখানে সাপের ভ্যাকসিন না থাকায় বাবুকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চার দিন লাইভ সাপোর্টে থাকার পর (৬ নভেম্বর) রাত দেড়টার দিকে মারা যান। ডাক্তারি পরীক্ষায় দংশন করা সাপটি রাসেল ভাইপার বলে নিশ্চিত করা হয়। এ ঘটনায় লৌহজংয়ে পদ্মাপাড় সংলগ্ন গ্রামগুলোতে অত্যন্ত বিষধর রাসেল ভাইপার সাপের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে এক ব্যক্তি পদ্মার চর থেকে রাসেল ভাইপারকে অজগর সাপ ভেবে তার বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর রাসেল ভাইপারের কামড়ে তিনি মারা যান। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় রাসেল ভাইপারের কামড়ে এটিই প্রথম মৃত্যু বলে ধারণা করা হয়।
২০১৯ সালে ঢাকার বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের সদস্যরা উপজেলার মালিরঅংক গ্রাম থেকে ৪ ফুট দৈর্ঘ্যরে একটি রাসেল ভাইপার সাপ উদ্ধার করে। উপজেলা থেকে এটিই প্রথম উদ্ধার করা হয়। পরে উদ্ধার রাসেল ভাইপারটি ঢাকার আগারগাঁও এর বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, বন বিভাগের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয় পাহাড়ি ঢলের পানির সঙ্গে দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে উপজেলার পদ্মা নদীর তীরবর্তী এলাকায় এ সাপ নেমে এসেছে।
সেই সময় উদ্ধারকারী দল এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও তাদের দেওয়া ভিডিও ফুটেজ দেখে ভয়ঙ্কর বিষধর ফিমেল রাসেল ভাইপারসহ ৩টি রাসেল ভাইপার সাপের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। তিনটির মধ্যে একটি উদ্ধার করা হয়, একটি স্থানীয়রা মেরে ফেলে এবং আরেকটি কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় বাচ্চা প্রসবের মাধ্যমে কয়েকটি স্থানে বংশ বিস্তারও করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিগত ৪-৫ বছর ধরে লৌহজংয়ে বিরল প্রজাতির এই মারাত্মক বিষধর রাসেল ভাইপারের বিস্তার ঘটেছে। এ সাপের কামড়ে অন্তত ৪ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের গত ২৭ জুলাই উপজেলার কনকসার গ্রামের টিংকু বর্মনকে বিষাক্ত রাসেল ভাইপার কামড়ায় ভাগ্যচক্রে বেঁচে যায় সে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে চিকিৎসার কারণে।
উল্লেখ্য, মারাত্মক বিষধর প্রজাতির এ রাসেল ভাইপার (চন্দ্রবোড়া) সাপ নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত পরিবেশে এবং কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। এরা নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকি ও ব্যাঙ ভক্ষণ করে। অন্যান্য সাপ সাধারণত ডিম পাড়ে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। তবে রাসেল ভাইপার সাপ ডিম পাড়ার পরিবর্তে সরাসরি বাচ্চা দেয়। এরা বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করে। একটি স্ত্রী সাপ গর্ভধারণ শেষে ২০ থেকে ৪০টি বাচ্চা দেয়। তবে কোনো কোনো রাসেল ভাইপার সাপের ৭৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দেওয়ার রেকর্ড আছে। এরা প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে।
পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই রাসেল ভাইপারের কামড়ে মারা যায়। অন্যান্য সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও এ সাপটির স্বভাব ঠিক তার উল্টো। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ‘কিলিংমেশিন’ হিসেবে বদনাম রয়েছে সাপটির। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ।
এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। রাসেল ভাইপারের বিষ হোমটক্সিন, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়। তীব্রতার দিক দিয়ে সাপটি বিশ্বের ৫ নম্বর ভয়ংকর বিষধর সাপ। কিন্তু মাত্র ১ সেকেন্ডের ১৬ ভাগের ১ ভাগ সময়ে কাউকে কামড়ে বিষ ঢালতে পারে সাপটি! কামড়ের ক্ষিপ্রগতির দিক দিয়ে সব সাপকে হারিয়ে রাসেল ভাইপার প্রথম স্থান দখল করেছে। অন্যান্য সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে ফেলে কিন্তু হিংস্র রাসেল ভাইপার শিকারকে শুধু একা নয়, তার পুরো পরিবারসহ খেতে ভালোবাসে। রাসেল ভাইপার সাপ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দুর্লভ প্রজাতির একটি সাপ। এটি পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জেলার গ্রাম অঞ্চলে ভয়ের অন্যতম কারণ। আগে শুধু বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলে এ সাপ পাওয়া গেলেও বর্তমানে এরা পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলা ও চরগুলোতেও বিস্তার লাভ করেছে। সাপটির কবল থেকে বাঁচতে সচেতনতাই কার্যকর পথ।