Logo
Logo
×

সারাদেশ

রাজশাহীতে চার ঘণ্টায় দুই চিকিৎসক খুন, আতঙ্ক ছড়িয়েছে নগরীতে

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ১১:২৬ পিএম

রাজশাহীতে চার ঘণ্টায় দুই চিকিৎসক খুন, আতঙ্ক ছড়িয়েছে নগরীতে

রাজশাহী মহানগরীতে এক রাতে চার ঘণ্টার ব্যবধানে দুই চিকিৎসককে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। একজন পল্লিচিকিৎসক ও একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ খুনের এ ঘটনায় নগরবাসীর মাঝে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রথম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে রোববার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে। দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটে নগরীর বর্ণালি মোড় এলাকায় রাত পৌনে ১২টায়। একই কায়দায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা মাইক্রোবাসে করে ঘটনাস্থলে এসে নির্বিঘ্নে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নিরাপদে চলে যায়।

নিহতের পরিবারের সদস্য, পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, রোববার সন্ধ্যার পর আরএমপির চন্দ্রিমা থানার পারিলা ইউনিয়নের কৃষ্টগঞ্জ বাজারে নিজের চেম্বারে রোগী দেখছিলেন পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলাল (৪৮)। কিছুটা অন্ধকার হয়ে এলে একটি হাইয়েস মাইক্রোবাসে করে ৬-৭ জন মুখোশধারী সশস্ত্র দুর্বৃত্ত চেম্বার থেকে এরশাদ আলী দুলালকে রড দিয়ে পেটাতে পেটাতে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। চলে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তরা ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। রাত ৮টার দিকে আরএমপির শাহমখদুম থানার সিটিহাট এলাকার পূর্বদিকের একটি নির্জন সড়ক থেকে চিকিৎসক দুলালের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় আরএমপির চন্দ্রিমা থানায় একটি হত্যা মামলা হয়েছে। পুলিশ দুজনকে গ্রেফতার করেছে।

অন্যদিকে রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে রাজশাহী মহানগরীর প্রাণকেন্দ্র বর্ণালি মোড় এলাকায় মুখোশধারী একদল দুর্বৃত্ত উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ গোলাম কাজেম আলী আহমেদকে (৪৬) নৃশংসভাবে হত্যা করে। নিহত চিকিৎসক কাজেম আলী রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ৪২তম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার লক্ষ্মীপুর থেকে চেম্বার শেষ করে মোটরসাইকেলে উপশহরের বাসায় ফিরছিলেন। বর্ণালি মোড়ের কোরাইশী অ্যালুমিনিয়ামের সামনে মোটরসাইকেলের গতিরোধ করে কাজেম আলীকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে চলে যায় দুর্বৃত্তরা। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১টার দিকে মারা যান তিনি। পুলিশ কাজেম আলীর মোটরসাইকেল সহযাত্রী শাহীন আলীকে আটক করেছে। কাজেম আলীর স্ত্রী চিকিৎসক ফারহানা সোমা সোমবার দুপুরে বাদী হয়ে আরএমপির রাজপাড়া থানায় অজ্ঞাত ৭-৮ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেছেন।

নিহতের পরিবারের সদস্য, এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পল্লিচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলাল পবা উপজেলার পারিলা ইউনিয়নের কৃষ্টগঞ্জ বাজারের সামিল আলী হাজির ছেলে। বাজারে একটি চেম্বার খুলে গ্রামের রোগীদের চিকিৎসা দিতেন। কিছুদিন ধরে তার সৎ-চাচা রেজাউল ইসলামের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে বিবাদ চলছিল তার পরিবারের। রেজাউল মাঝেমধ্যে ভাড়া করা সন্ত্রাসী নিয়ে গিয়ে দুলাল ও তার পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে আসত।

নিহত দুলালের বড় ভাই আলাউদ্দিন বলেন, রোববার সন্ধ্যার পর তার ভাইকে তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা পুলিশের ৯৯৯ নম্বরে ফোন দেন। চন্দ্রিমা থানা পুলিশকে জানান। খোঁজাখুঁজির একপর্যায়ে সিটি হাট এলাকার একটি গলিপথে দুলালের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছুরিকাঘাত ছাড়াও ভারী জিনিস দিয়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

চন্দ্রিমা থানার ওসি মাহবুব আলম জানান, রাতেই নিহত ডা. দুলালের ছোট ভাই রুহুল আমিন বাদী হয়ে সৎ-চাচা রেজাউল করিমসহ অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেছেন। পুলিশ রোববার রাতে অভিযান চালিয়ে দুলালের সৎ-চাচা রেজাউল ইসলাম ও তার ছেলে আতিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে। তাদেরকে থানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশের দুটি টিম।

অন্যদিকে রাজপাড়া থানার ওসি রফিকুল হক বলেন, ডা. কাজেম আলীর হত্যাকাণ্ড ‘পূর্বপরিকল্পিত’। কারণ, ঘটনার সময় কাজেম আলীর কাছে টাকাপয়সা ছিল। হত্যাকারীরা টাকাপয়সা নেয়নি। এ থেকে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, কাজেম আলীকে শুধু হত্যার মিশন নিয়েই দুর্বৃত্তরা এসেছিল।

জানা যায়, কাজেম আলী আহমেদের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দেবীনগর ইউনিয়নের ইব্রাহিম মণ্ডলের গ্রামে। বাবার নাম গোলাম মোর্তুজা। কিছুদিন আগে সরকারি চাকরি ছেড়ে রাজশাহীর পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চেম্বার করতেন। তিনি রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মা ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামের একটি প্রাইভেট হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। সপ্তাহে দুই দিন তিনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে গিয়ে রোগী দেখতেন। চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে কাজেম আলী বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন রাজশাহীতে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে রাজশাহী মহানগরীর উপশহর এলাকায় নিজ বাড়িতে বসবাস করতেন। চিকিৎসক কাজেমের স্ত্রী ফারজানা ইসলাম সোমা রাজশাহী মেডিকেল কলেজের প্যাথোলজি বিভাগে এমডি কোর্স করছেন। কারও সঙ্গেই তাদের খারাপ কোনো সম্পর্ক ছিল না।

পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বলেন, চিকিৎসক স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই পৃথক প্রাইভেট কার রয়েছে। কিন্তু তিনি এত রাতে একজন ওষুধ সরবরাহকারীর মোটরসাইকেলে করে কেন বাসায় ফিরছিলেন, সেই প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, ডা. কাজেম আলী চেম্বার শেষে প্রতিদিন প্রাইভেট কারে বাসায় ফেরেন। চেম্বারে রোগী দেখা বাবদ টাকাপয়সা থাকে তার কাছে। রোববার নিহত হওয়ার সময়ও তার পকেটে ভালো পরিমাণ টাকা ছিল। কিন্তু হত্যাকারীরা টাকা নিয়ে যায়নি। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় কারও হাত থাকতে পারে বলে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

এদিকে চিকিৎসক কাজেম আলীর খুনিদের শনাক্ত করে দ্রুত গ্রেফতারের দাবিতে নগরীতে মানববন্ধন করেছে রাজশাহীস্থ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সমিতি ও দেবীনগর স্টুডেন্ট ফোরাম। রোববার দুপুরে নগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে এই মানববন্ধনে অংশ নেন রাজশাহীতে বসবাসকারী চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

আরএমপির গণমাধ্যম মুখপাত্র এডিসি জামিরুল ইসলাম বলেন, একই রাতে দুই চিকিৎসক খুনের ঘটনা পুলিশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। ইতোমধ্যে ডা. কাজেম আলীর হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী সহযাত্রী শাহীনকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। দ্রুতই দুটি খুনের রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে বলে তারা আশা করেন।

চিকিৎসকদের কর্মবিরতি পালন, মঙ্গলবার মানববন্ধন : চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ গোলাম কাজেম আলী আহমেদ হত্যার প্রতিবাদে সোমবার রাজশাহীতে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখা বন্ধ রেখেছেন চিকিৎসকরা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) রাজশাহী শাখার সভাপতি ডা. এবি সিদ্দিকী ও ডা. নওশাদ আলী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ডা. কাজেম আলী খুনের ঘটনায় রাজশাহীর চিকিৎসক সমাজ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সোমবার প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগী দেখা বন্ধসহ মঙ্গলবার নগরীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি পালন করবেন রাজশাহীর চিকিৎসকরা। তারা অবিলম্বে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শনাক্ত করে গ্রেফতার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানান।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম