Logo
Logo
×

সারাদেশ

দুষ্টচক্র থেকে কেন বের হতে পারছে না দেশের দরিদ্রতম অঞ্চল

Icon

মাসুদ করিম, রৌমারী (কুড়িগ্রাম) থেকে

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০৫:০২ পিএম

দুষ্টচক্র থেকে কেন বের হতে পারছে না দেশের দরিদ্রতম অঞ্চল

কুড়িগ্রাম শহরে নেমে তেমন চাকচিক্য চোখে পড়লো না। অনেকটা শান্ত নদীর মতো। দুই দশক আগে দোকানপাটের চেহারা যেমন ছিলো প্রায় তেমনই আছে। দেশের অন্য যে কোনো জেলা শহর থেকে আলাদা। রিকশা ভাড়া কম। খাবার খরচ কম। মানুষের আয় কম। তাই জীবনযাত্রার ব্যয় অন্য জেলা শহরের তুলনায় কম। ভাওয়াইয়ার তীর্থভূমি এই ছোট্ট শহরে সংস্কৃতির চর্চা এখনও আছে। তবে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। তরুণ সমাজে আসক্তি বাড়ছে। কুড়িগ্রাম শহরে শোভা পাচ্ছে সরকারের উন্নয়ন ফিরিস্তি সম্বলিত ফেস্টুন। 

ফেস্টুনে লেখা আছে, তিস্তা ও ধরলা নদীর ওপর দু'টি সেতু নির্মাণ, সোনা হাট স্থলবন্দর ও চিলমারি নৌবন্দর উন্নয়ন, কুড়িগ্রাম-ভূরঙ্গমারী-সোনাহাট ফোরলেন রাস্তা, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। উন্নয়নের ফলে মানুষের কর্মচাঞ্চল্য সামান্য বেড়েছে। মঙ্গা তথা অভাবের জেলা হিসেবে পরিচিত কুড়িগ্রামে এখন মঙ্গা না থাকলেও দারিদ্র্য এখানে চক্রাকারে ঘুরছে। 

কুড়িগ্রাম প্রেস ক্লাবে বসে কথা হচ্ছিল স্থানীয় সাংবাদিক আহসান হাবীব নীলুর সঙ্গে। প্রেস ক্লাবটা বেশ জীর্ণ। জেলা শহরের প্রেস ক্লাব আরও উন্নত অবকাঠামোর প্রয়োজন ছিলো। নীলুর কাছে প্রশ্ন, দারিদ্র্য কেন কমছে না?  নীলু বললেন, দারিদ্র্য একদমই কমছে না এমন নয়। আগে অনেক সময় মানুষ খেতে পারতো না। মঙ্গা ছিল নিত্যসঙ্গী। এখন মানুষের খাবারের অভাব তেমন না থাকলেও প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব রয়েছে। 

কুড়িগ্রাম দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা। দারিদ্র্যের হার প্রায় প্রায় ৭০ শতাংশ। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থাকলেও দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। এর কারণ কি? এক কথায় নীলুর জবাব, নদীভাঙ্গন। ব্রক্ষপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমারসহ ছোটবড় ১৬টি নদী কুড়িগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। চরাঞ্চল বেশি। শিল্প-কলকারখানা নেই। মানুষের কর্মসংস্থান নেই। প্রতি বছর তিন হাজার পরিবারের বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলিন হয়। দারিদ্র্যের প্রধান কারণ নদীভাঙ্গন। 

রৌমারীর উদ্দেশ্যে কুড়িগ্রাম জেলা শহর থেকে মাইক্রোবাসে রওনা দিলাম সকাল আটটায়। উলিপুর হয়ে চিলমারি বন্দরে পৌছঁতে লাগল প্রায় এক ঘন্টা। এই সেই বিখ্যাত চিলমারি বন্দর। ভাওয়াইয়া গান, ও কি গাড়িয়াল ভাই / হাঁকাও গাড়ি চিলমারি বন্দরে। চিলমারি একটি বাণিজ্যিক অঞ্চল। ঘাটে ঘাটে বালুরস্তূপ। বন্দরে সারিবদ্ধ ট্রাক। ফেরি চলে সময় বেঁধে। 

নৌকাযোগে ব্রক্ষপুত্র পাড়ি দিতে রওনা দিলাম। শীতল বাতাস। নদীর বাতাসে ভাবের উদয় হয়। কিছু দূর এগোলে চর চোখে পড়ল। নদীর বুকে অনেক মাছ ধরার নৌকা জাল পেতে বসে আছে। ইলিশ রক্ষায় এই সময়টায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ। নৌকার মাঝি আমাদের জানালেন, মাঝে মাঝে পুলিশ অভিযান চালায়। তবে পুলিশকে মাছ দিলে জাল দিয়ে দেয়। দুই ঘন্টা চলার পর হঠাৎ নৌকা চরে আটকে গেলো। মাঝিরা মাঝ নদীর ডুবোচরে নামলেন। কারো হাঁটু পানি কারও কোমর পানি। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নাই। নীচে চর আছে। প্যাসেস অনুমান করে নৌকা চলে। কসরত চলছে। নৌকা কিছুতেই চলছে না। নৌকায় অনেক শিশু ও নারী। গরমে তাদের ত্রাহি অবস্থা। মাঝিরা লগি-বৈঠা নিয়ে চেষ্টা চালান। আধাঘন্টার বেশি সময় প্রাণান্ত চেষ্টার পর নৌকা চলতে শুরু করেছে। স্বস্তি নামে। তখনই মনে হচ্ছিল ব্রক্ষপুত্রের ওপর একটি সেতু হলে ভাল হতো। চিলমারি থেকে প্রায় তিন ঘন্টা ইঞ্জিন চলার পর রৌমারি ঘাটে ভীড়লো নৌকা। 

রৌমারী পৌঁছার পর একই প্রশ্ন, দারিদ্র্য এখানে বেশি কেন?  সবার জবাব একটাই, দুর্গম এলাকা। বেসরকারি বিনিয়োগ সম্ভব নয়। সরকার পিছিয়ে পড়া জেলা হিসেবে আগ্রাধিকারমূলক বিনিয়োগ করলে উন্নয়ন বৈষম্য দূর হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা দুর্গম হওয়ায় পণ্যের দাম পায় না কৃষক। নদীভাঙ্গনের ফলে মানুষ বারবার নিঃস্ব হচ্ছে।  শিক্ষা, কৃষি, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক অতিরিক্ত সরকারি বরাদ্দ ছাড়া অবহেলিত এই জনপদকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা সম্ভব নয়।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম