শিক্ষা কর্মকর্তার ঘুসের রেট: প্রধান শিক্ষক নিয়োগে ১ লাখ, কর্মচারী ৬০ হাজার
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:৪৪ পিএম
গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলম বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগ। ছবি: যুগান্তর
নিয়মিত আসেন না অফিসে। উপস্থিত থাকেন না কোনো জাতীয় দিবসের সরকারি কর্মসূচিতে। সরকারি-বেসরকারি কারও ফোনই তিনি রিসিভ করেন না। তবে কড়ায়-গণ্ডায় ঘুস আদায়ে তার জুড়ি মেলা ভার। গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলমের বিরুদ্ধে পাহাড় সমান অভিযোগ জমা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন:বিসিএস কর্মকর্তার করুণ গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রীর চোখে জল!
অভিযোগ রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, উপপরিচালক ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের কোনো নজর নেই সেদিকে। শিক্ষা বিভাগের উদাসীনতায় ঘুস আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন শিক্ষা বিভাগের এই কর্মকর্তা। দুলাল আলমকে ঘুস দিতে দিতে অতিষ্ঠ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। এমনকি অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পান না।
গোদাগাড়ীর শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ বোর্ডে সদস্য হিসেবে থাকেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার। কোনো স্কুলে প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষক নিয়োগ হলে দুলাল আলম নিয়ে থাকেন ৬০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা। স্কুলের কর্মচারী নিয়োগে দুলাল আলমের ধরাবাধা রেট ৪০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
অগ্রিম ঘুসের টাকা না পেলে ফোন বন্ধ রেখে অনুপস্থিত হয়ে যান তিনি। ঘুস ছাড়া উপজেলা শিক্ষা দপ্তরে একটা ছোট কাজও হয় না। ভুক্তভোগী শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সূত্রে এসব অভিযোগ জানা গেছে।
এদিকে নিয়োগ বোর্ডে একদফা টাকা আদায়ের পর এমপিওর জন্য অনলাইনে ফাইল পাঠানোর সময় আরেক দফা টাকা নেন দুলাল আলম। এমনকি এনটিআরসি থেকে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের বেতনভাতার ফাইল পাঠাতেও দুলাল আলমকে ১০ হাজার থেকে ঊর্ধ্বে ৪০ হাজার টাকা দিতে হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা আরও জানান, কোনো শিক্ষকের উচ্চতর বেতনস্কেল, বিএড স্কেলের আবেদন, শূন্যপদের অনুমোদনেও ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা তাকে বাধ্যতামূলকভাবে দিতে হয়। টিউশন ফি ও উপবৃত্তির প্রত্যায়ন নিতে গেলেও দুলাল আলমকে শেষমেষ ৫ হাজার টাকা দিতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। শিক্ষকদের আরও অভিযোগ— টাকা না পেলে একটা ফাইলও নড়ে না।
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা আরও জানান, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার দুলাল আলম গোটা উপজেলা পরিষদে এক নম্বর ঘুসখোর অফিসার হিসেবে চিহ্নিত। আলমের ঘুসের টাকা আদায় করেন তার অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন। আনোয়ার হোসেন স্বীকার করেন, স্যার যখন নিতে বলেন আমি তখন নিয়ে থাকি। আমার কিছু করার নেই।
উপজেলার লস্করহাটি স্কুলের এক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এনটিআরসি থেকে নিয়োগ পেয়ে সম্প্রতি স্কুলে যোগদানের পর বেতনভাতার জন্য ফাইল পাঠানোর অনুরোধ করি মাধ্যমিক কর্মকর্তাকে। শিক্ষা কর্মকর্তা ৫ হাজার টাকা দাবি করে বসেন।
শেষে দরাদরি করে ৪ হাজারে ফয়সালা হয়। পরে তিনি ডিডি অফিসে ফাইল প্রেরণ করেন। উপজেলার হুজরাপুর স্কুলের সহকারী এক শিক্ষক আরও বলেন, আমার উচ্চতর বেতন স্কেলের ফাইল দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিলেন টাকা না পেয়ে। অবশেষে ৯ হাজার নিয়ে ফাইল ছেড়েছেন মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার।
মাটিকাটা উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, তিনজন কর্মচারী নিয়োগসহ বেতনভাতা করে দেওয়ার শর্তে তিনি ৬ লাখ টাকা নেন। কিন্তু পরে বেতনভাতার ফাইল পাঠাননি দীর্ঘদিন। টাকা ফেরত চাইলেও তাও দেননি। অভয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ তিনজন কর্মচারী নিয়ে দুলাল একাই এক লাখ ২০ হাজার টাকা নেন। কুতুবুল আলম শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলমের এই বেপরোয়া ঘুসবাণিজ্যের অভিযোগে সম্প্রতি মাউশির ডিজি, উপপরিচালক ও জেলা শিক্ষা অফিসারকে লিখিত অভিযোগ দেন।
জানা গেছে, পিরোজপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক তোতার সঙ্গে দুলাল আলমের সুসম্পর্ক থাকায় ৩ জন কর্মচারী নিয়োগে ১৫ হাজার করে মোট ৪৫ হাজার টাকা নেন। দুলাল আলমের সহকারী আনোয়ার হোসেনের বক্তব্য অন্য স্কুল হলে স্যার আরও বেশি নিতেন।
ললিত নগর স্কুলের সভাপতি তরিকুল ইসলাম মাধ্যমিক কর্মকর্তা দুলাল আলমের সঙ্গে যোগসাজশ করে গোপনে কাগজপত্র তৈরি করে তিনজন কর্মচারী নিয়োগের দিন ধার্য করেন।
এ ক্ষেত্রে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আব্দুল লফিতকে কিছুই জানতে দেওয়া হয়নি। তিন কর্মচারীর কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা বিষয়টি জানতে পেরে নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠানে আপত্তি তোলেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজাবাড়ী স্কুলের ৫টি পদের নিয়োগে দুলাল আলম প্রথমে বেশি টাকা দাবি করেন। অগ্রিম টাকা না পাওয়ায় প্রথম দিন নিয়োগ বোর্ডে অনুপস্থিত থাকেন। পরে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতে পেয়ে শেষে তিনি নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হন। দুলাল আলম মাদক মামলার এক আসামিকেও নিয়োগ দেন। হুজরাপুর স্কুলের তিন কর্মচারী নিয়োগে নেন ৯০ হাজার টাকা।
গোদাগাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুলাল আলম ঘুস পেলে এমন কাজ নাই যা করতে পারেন না।
জানা গেছে, নিয়োগ অবৈধ দাবি করে স্কুলের শিক্ষক কবিরুল ইসলাম আদালতে মামলা করেছেন। প্রেমতলী সুকবাসিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ দুই কর্মচারী নিয়োগে শিক্ষা কর্মকর্তা দুলাল আলম নিয়েছেন ৫০ হাজার টাকা। নলিত্রী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চারজনের নিয়োগে নেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই অবৈধ নিয়োগে সহায়তা দিয়ে দুলাল আলমের পকেটে ঢুকেছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে গোদাগাড়ী উপজেলা মাধ্যমিক কর্মকর্তা দুলাল আলম ঘুস নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি জানান, তার স্ত্রী অসুস্থ থাকায় তিনি অনেক সময় ফোন ধরতে পারেন না। জাতীয় দিবসের সরকারি কর্মসূচিতে থাকতে পারেন না।