Logo
Logo
×

সারাদেশ

ব্যাংকের চাকরি যেন আলাদিনের চেরাগ, ১৪ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক মুরাদ

Icon

আহমদ মুসা রঞ্জু, খুলনা 

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১২:২৮ পিএম

ব্যাংকের চাকরি যেন আলাদিনের চেরাগ, ১৪ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক মুরাদ

খুলনায় রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা মুরাদ হোসেন ১৪ বছরের চাকরি জীবনে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। সম্পদের তালিকায় রয়েছে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি, গরুর ফার্ম, ওষুধের দোকান, বিলান জমি ও মাছের ঘের। এলাকার স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দান সদকায় তার নাম সবার মুখে। আত্মীয়স্বজনের নামেও তৈরি করে দিয়েছেন নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি। সম্প্রতি খুলনার তিন মাছ কোম্পানিকে ভুয়া রপ্তানি কাগজপত্রের মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ ছাড় করানোর অভিযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

রূপালী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হিমায়িত মাছ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান প্রিয়াম ফিশ এক্সপোর্ট লিমিটেড ও বায়োনিক সি ফুড এক্সপোর্ট লিমিটেড ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে রূপালী ব্যাংক খুলনার শামস ভবন শাখা থেকে প্রায় ৯৪ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এই অর্থ তছরুপের বিষয়ে এখন অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলমান। এই শাখায় সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন মুরাদ হোসেন। ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তদন্তে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি সামনে এলে ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাকির ইবনে বোরাক এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এ ঘটনার পর মুরাদকে ময়মনসিংহের একটি শাখায় বদলি করা হয়েছে। একই সঙ্গে অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনও পৃথক তদন্ত করছে।

এ ঘটনার পর দৈনিক যুগান্তরের অনুসন্ধানে বের হয়েছে বেশ কিছু তথ্য। মাছ কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা ভুয়া এলসির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ওই দুই কর্মকর্তার সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ আলোচনা করতেন। এরপর প্রাপ্ত অর্থের একটি অংশ পেতেন কিছু কর্মকর্তা এবং বাকি টাকা মাছ কোম্পানিগুলো নিত। এর ধারাবাহিকতায় সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মুরাদ গত কয়েক বছরের ব্যবধানে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মুরাদের গ্রামের বাড়ি যশোর জেলার অভয়নগরের সিদ্ধিপাশা ইউনিয়নের নাউলী গ্রামে। তিনি চাকরিতে যোগ দেন ২০০৯ সালে। ১৪ বছরের এই চাকরি জীবনে অর্থেবিত্তে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন তিনি। গ্রামের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। রাস্তার পাশ ঘেঁষে সদ্য নির্মাণ করা দোতলা বাড়ি দেখে যে কারোরই চোখ ধাঁধিয়ে যাবে। বাড়িটির ঠিক উল্টো পাশে পাঁচ কাঠা জায়গাজুড়ে তার আরও একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। প্রধান সড়ক থেকে বাড়ির দুই তৃতীয়াংশ উঠোন ঢালাই দেওয়া। সেটি চলে গেছে পুকুর পাড় পর্যন্ত। পুকুরের দুই পাশের পাড় ইটের সলিং দিয়ে বাঁধানো। বাড়ির ঠিক উলটো পাশে রয়েছে একটি গরুর ফার্ম। বর্তমানে ফার্মটিতে কোনো গরু নেই। গেল কোরবানির ঈদে বিক্রি করা হয়েছে। বাড়ি থেকে আধা মাইল দূরে প্রায় আট বিঘা জমি নিয়ে করা হয়েছে মাছের ঘের। ওই ঘেরটি দেখাশোনা করেন তার আপন ভাই জাহিদ হোসেন। সেখানে গেলে জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা এই ঘেরে মাছ চাষ করি। ভাই মুরাদ আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেন। তার আর্থিক সহযোগিতায় আমি এই ঘের প্রতিষ্ঠা করেছি। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূবের বিলে আমাদের আরও ১০ বিঘা জমি আছে। এগুলো ভাই (মুরাদ) কিনেছেন। এছাড়াও তার দৌলতপুরে বাড়ি ও ফার্ম হাউজ এবং ওষুধের ফার্মেসি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ভাই চাকরি পাওয়ার পর আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে।’

খুলনা মহানগরীর দৌলতপুর কুলিপাড়ায় মুরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৫ কাঠা জায়গাজুড়ে চারতলা বাড়ি। বাড়ির সব ইউনিট ভাড়া দেওয়া। ওই বাড়ির সদর দরজায় বাড়ি ভাড়ার নোটিশ দেওয়া রয়েছে। উক্ত নম্বরটিতে ফোন করলে এক নারী রিসিভ করেন। তিনি নিজেকে ব্যাংকার মুরাদ হোসেনের স্ত্রী পরিচয় দেন। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ফোনটি কেটে দেন। দৌলতপুরের পার্শ্ববর্তী আড়ংঘাটা বাইপাস এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে প্রায় এক বিঘা জমির ওপর করা হয়েছে ফার্ম হাউজ ও বাগানবাড়ি। বাড়ির বাইরে নেমপ্লেটে মুরাদ হোসেনের নাম লেখা রয়েছে। এখানে দোতলাবিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক বাংলো বাড়ি রয়েছে। গরুর ফার্মে তিনটি বিদেশি জাতের গরু রয়েছে। এ ফার্ম দেখাশোনার জন্য একজন কর্মচারী রয়েছেন। তিনি জানান, এখানে ৩০টি বিভিন্ন জাতের গরু ছিল। সেগুলো কুরবানির ঈদে বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়াও পাশের পুকুরটি তিনি সাহেবকে (মুরাদ) বলে মাছ চাষ করেন। ওই জমির মূল্য প্রায় কোটি টাকা। এছাড়াও দৌলতপুর ঠিক মহসীন মোড়ের উপরে ব্যাংকার মুরাদের মালিকানাধীন একটি বড় ওষুধের ফার্মেসি রয়েছে।

এর বাইরে অভয়নগর উপজেলার সিদ্ধিপাশা এলাকায় যেখানে মুরাদের বাড়ি ওই এলাকার ধনী ও গরিব সব মানুষকেই নিয়মিত সাহায্য সহযোগিতা করেন মুরাদ। আত্মীয় পরিচয় দেওয়া ইকরাম হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘মুরাদ ভাই বড় কলিজার মানুষ। এলাকার কেউ বিপদে পড়লে তাকে সাহায্য করেন। স্থানীয় মসজিদ-মাদ্রাসার ছাদ ঢালাইসহ বিভিন্ন উন্নয়নে দান করেন দেদার। এলাকায় তার নামডাক আছে বেশ।’ পরিবারের সদস্যদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পিতা স্থানীয় একটি জুট মিলে নিু পদে চাকরি করতেন। তারা চার ভাই। এরমধ্যে একভাই প্রাইমারি স্কুলে চাকরি করেন। বাকি দুজন ব্যবসা বাণিজ্য দেখাশোনা করেন। স্থানীয় নাউলী বাজারে তাদের একাধিক দোকান ঘর রয়েছে।’ সাংবাদিক পরিচয় জানার পর ইকরাম বিভিন্নভাবে এ প্রতিবেদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।

এসব বিষয়ে জানতে ব্যাংক কর্মকর্তা মুরাদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলতে তার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠানো হলেও এর উত্তর দেননি। যদিও ক্ষুদেবার্তাটি তিনি সিন করেছেন।

মুরাদ রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসাবে যোগদান করেন ২০০৯ সালে। মাত্র ১৪-১৫ বছরের চাকরি জীবনে এত সম্পদ অর্জনের বিষয় নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যেও রয়েছে নানা কৌতূহল।

সিদ্দিপাশা ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মো. কাশেম বলেন, ‘তার বাবা জুটমিলে কর্মচারী ছিলেন। কয়েক বছর ধরেই মুরাদের পরিবার আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল হয়েছে। খরচের হাত এবং বিলাসী জীবনযাপন নিয়েও একসময় মনে প্রশ্ন জেগেছিল। পরে শুনেছিলাম ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি তার অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে পরে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি।’

ব্যাংকের অর্থ তছরুপের বিষয় নিয়ে দুদক খুলনা জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালক আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য পাঠায়নি। তবে ওই দুই কর্মকর্তার সম্পদ এবং অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের বিষয় নিয়ে আমরা তদন্ত শুরু করেছি। রূপালী ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. এহতেশামুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, দুই মাছ কোম্পানির ভুয়া এলসির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের বিষয়টি ধরা পড়ার পর আমরা তদন্ত করছি। বাংলাদেশ ব্যাংকও পৃথক তদন্ত করছে। এ ঘটনায় সাবেক ব্যবস্থাপক ও উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) জাকির ইবনে বোরাক এবং সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মুরাদ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আমরা এখন টাকা ফেরত আনার চেষ্টা করছি। তদন্ত শেষ হলে বোর্ড পরবর্তি সিদ্ধান্ত নেবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম