পুতিনের কণ্ঠে পাবনা উচ্চারণ, জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত রূপপুর
আখতারুজ্জামান আখতার, রূপপুর থেকে ফিরে
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:৪১ পিএম
দুপুর ১২টা থেকেই আমন্ত্রিত অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। দুপুর ২টা না বাজতেই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুপরিসর সম্মেলন কেন্দ্রের সব আসন ভরে যায়। আমন্ত্রিত সবাই রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, দেশি বিদেশি উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, সংবাদ কর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার বিশিষ্টজন।
সবার চোখে মুখে আবেগ-উত্তেজনার ছাপ! আর অপেক্ষা যেন সয় না, কখন শুরু হবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! অবশেষে দুপুর ২টা ৫৩ মিনিটে পর্দায় আসেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এ সময় অভ্যাগতদের মুহুর্মুহু করতালি আর আনন্দ চিৎকারে পুরো সম্মেলন কেন্দ্রে এক অন্যরকম পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো এলাকা।
বৃহস্পতিবার এমনই ছিল পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের সময়কার আনন্দময় মুহূর্ত; যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। এদিকে এই পারমাণবিক জ্বালানি ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে পারমানবিক ইউরেনিয়ামের মালিক হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলো বাংলাদেশ।
শুধু তাই নয়, রাশিয়ার লৌহ শাসক পুতিনের কণ্ঠে বাংলাদেশ এবং উত্তরবঙ্গের জেলা পাবনার নাম উচ্চারণে পুরো রূপপুর যেন তখন গর্বিত এক খণ্ড বাংলাদেশে পরিণত হয়েছিল। এ সময় সবার মুখে উচ্চারিত হয় সাবাস বাংলাদেশ, সাবাস পাবনা!
বৃহস্পতিবার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি সরবরাহ সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়। গণভবনে বৃহস্পতিবার বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ সনদ তুলে দেওয়া হয়।
বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টা ৫২ মিনিটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনলাইন উপস্থিতিতে ঐতিহাসিক হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি।
হস্তান্তর উপলক্ষে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে আয়োজন করা হয় গ্র্যাজুয়েশন সেরিমনি।
অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, আজ এই জ্বালানি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক জ্বালানি শক্তিধর দেশে পরিণত হলো। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প কেবল একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ নয় এটি দুই দেশের বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
তিনি বলেন, ৫০ বছর আগের একটি পৃথক রাষ্ট্র সৃষ্টি থেকে রাশিয়া বাংলাদেশর পাশে ছিল এবং সব সময় বাংলাদেশের পাশে আছে। তিনি তার বক্তৃতায় পাবনার রূপপুরের নাম উচ্চারণ করেন।
এ সময় উপস্থিত অতিথিরা উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় প্রকল্প এলাকা।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণভাবে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশ সবসময় পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান। পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আমরা এই প্রকল্প নিয়েছি। রাশিয়া আমাদের সহযোগিতা করেছে। রূপপুর প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।
এ সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের মোদি সরকারের প্রশংসা করে বলেন, ভারতও সব সময় সহযোগিতা করেছে এবং এখনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ভারতে অনেক কর্মীকে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়েছে। দুই দেশের সরকার প্রধানের অনুমতিতে সেখান পারমাণবিক জ্বালানির একটি নমুনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে হস্তান্তর করেন রুশ পরমাণু শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। এটি হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হলো বাংলাদেশ।
অনুষ্ঠানে অতীতের মতো কবিতা দিয়ে শুরু এবং কবিতা দিয়ে শেষ করা বক্তব্য দিয়ে প্রশংসিত হন মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান।
রসাটম মহাপরিচালক লিখাচেভ তার বক্তব্যে বলেন, শতভাগ পেশাদারিত্বের মাধ্যমে এবং সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এই প্রকল্প সম্পন্ন করা হচ্ছে। এটি শতভাগ নিরাপদ।
এ ছাড়া প্রকল্প পরিচালক শৌকত আকবর, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
এদিকে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান উপলক্ষে পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কজুড়ে এবং পুরো রূপপুর এলাকা বর্ণিলরুপে সাজানো হয়। রাশিয়ানদের আবাসন এলাকা গ্রিন সিটিতে রং বেরঙের বেলুনসহ সড়কে রঙের আলপনা অন্যরকম মাত্রা যোগ করে। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসে পৌঁছায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জ্বালানির প্রথম চালান। ২৯ সেপ্টেম্বর বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় জ্বালানি নেওয়া হয় প্রকল্প এলাকায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বৃহৎ প্রকল্প। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে খরচ হচ্ছে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের ব্যয় ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। আর রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা হিসেবে আসছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। আর ২০২৫ সালের মাঝামাঝি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে। দুটি ইউনিট চালু হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিটের ভৌত এবং অবকাঠামোগত কাজ শেষ হয়ে গেছে ৯০ শতাংশের বেশি। আর দ্বিতীয় ইউনিটের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়ামের দেশ এখন বাংলাদেশ।