সাগরে গিয়ে ১০ মাসে নিখোঁজ ৪২ জেলে
শিপুফরাজী, চরফ্যাশন প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৯:২৮ এএম
বঙ্গোপসাগরে ট্রলারে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন চরফ্যাশনের উপকূলের প্রায় ৫০ হাজার জেলে। কিন্তু জেলেদের জন্য নেই কোনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম। ফলে সমুদ্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছরই বাড়ছে প্রাণহানির ঘটনা।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা কিংবা বৈরী আবহাওয়ার মধ্যে অধিক লোভের আশায় জেলেদেরকে সাগরে পাঠান ট্রলার ও আড়ত মালিকেরা।
মালিকদের লোভের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়লে নিখোঁজ বা মৃত জেলের লাশ উদ্ধারে অনেক সময় মালিকদের পাশে পাওয়া যায় না। চলতি বছরে সাগরে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরতে গিয়ে গত ২৫ জুন ১৩ মাঝি-মাল্লাসহ চরফ্যাশনের সামরাজ ঘাটের জাহাঙ্গীর মাঝির ট্রলার ডুবে যায়।
এরপর গাফিলতির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। ঘটনার পর জাহাঙ্গীর মাঝি ও তার ছেলে আব্দুল গনিকে জেলেরা জীবিত উদ্ধার করেন। ২৮ জুন জাকির, রফিকুল ইসলাম, আনোয়ার ও জাকির-২ নামের আরো ৪ জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয় সাগর থেকে। এই ঘটনার ৬ দিন পর সাগরের তিন চর এলাকা থেকে নিখোঁজ শরীফ, মোহাম্মদ হারুন, আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, ফজলে করিম, নুর ইসলাম মো. শিহাব ও রহিম মাঝির লাশ উদ্ধার করেন স্বজনরা।
এদের সবার বাড়ি চরফ্যাশনে। পরিবারের অভিযোগ ট্রলারও আড়ত মালিকদের অসহযোগিতা প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও ট্রলারের অভাবে দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার তৎপরতা চালানো সম্ভব হয়নি।
নিহত নুর ইসলামের ভাই মো. রফিকের অভিযোগ, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আড়ত মালিক জয়নাল মিয়া ট্রলার দিয়ে সহযোগিতার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত করেননি। সেই সময় উদ্ধার অভিযান চালানো হলে সবাইকে জীবিত পাওয়া যেত।
নিহত শিহাবের চাচা সিরাজ জানান, আড়তদার জ্বালানির তেল দেওয়ার কথা বলে দুইদিন ঘুরিয়েছে। পরে বিভিন্ন জেলে ও ট্রলার থেকে তেল তুলে সাহায্য নিয়ে তারা সাগরে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে পাঁচ দিন পর ৫ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে পাইনি কোন সহযোগিতা অভিযোগ করছেন রহিম মাঝির ছেলে মিলন।
২০২২ সালে অক্টোবর মা ইলিশ মাছ রক্ষার অভিযানে মধ্যেই ভোলার শতাধিক ট্রলার সাগরে পাঠায় মালিকপক্ষ। গত ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সীত্রাং এর কবলে পড়ে ৭টি টলার ডুবে যায়। এর মধ্যে নুসরাত ট্রলারের ২০জন শারমিন ট্রলারের ৮জন এফবি তিন্নি ট্রলারের ৬ জন এফবি আম্মাজানের ১১জন সহ ৭৮ জন জেলে নিখোঁজ হয়। এর মধ্যে ভারতের কারাগার থেকে দুই দফায় ৩৬জন জেলে উদ্ধার হয়, নিখোঁজ রয়েছেন এখনও ৪২জন। নিখোঁজদের বাড়ি চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায়।
সিত্রাংয়ে চরফ্যাশনের মায়া ব্রিজ এলাকার মনির মাঝির ট্রলারটি ২২ মাঝি-মাল্লা নিয়ে ডুবে যায়। এর মধ্যে কাউকে এখনো পাওয়া যায়নি। দীর্ঘ ১০ মাস অতিবাহিত হওয়ার কারণে তাদের জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছেন স্বজনেরা।
নিখোঁজ মনির মাঝির স্ত্রী নুসরাত বেগম জানায়, মালিকপক্ষ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সাগরে মাছ ধরার নামে তাদের মৃত্যুর কোলে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি দুর্ঘটনার বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য হুমকি দিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সরকার বা মালিক পক্ষ নিখোঁজদের সন্ধানে তৎপরতা চালায়নি। দুর্ঘটনার পর থেকে এসব পরিবারের অভাবের মধ্যে থাকলেও তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। মনির মাঝির ট্রলারে ছিলেন চরফ্যাশন চর কর্মী ইউনিয়নের নাংলা পাতা গ্রামের তৈয়ব, কবির ও আবুল কাশেম। তারা ছিল পরিবার একমাত্র উপার্জনকারী তাদের অনুপস্থিত পরিবার নেমে এসেছে চরম দুদর্শা।
আবুল কাশেমের ভাই মিজান অভিযোগ করেন, মালিকপক্ষের লোভের কারণে তারা এখন নি:স্ব। সাগরে গিয়ে প্রাণ গেলে বিচার বা সাহায্য কিছুই পায় না।
একই এলাকার ট্রলার চালক মাঝি নুরুল ইসলাম সিত্রাং এর কবল থেকে বেঁচে ফিরেছেন। তিনি জানান, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে ম্যানেজ করে ট্রলার সাগরে পাঠানো হয়েছে। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়ার কারণে ঝুঁকির মধ্যেও সাগরে যেতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে জেলেই।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী জেলে সমিতি চরফ্যাশন উপজেলার সভাপতি মো. সোহাগ জানান, মালিকপক্ষের লোভের কারণে সাগরে জেলেদের সলিল সমাধির ঘটনা বেড়ে চলছে। সাগরে ডুবে নিখোঁজ জেলে পরিবারের দুদর্শা লাঘবে সরকার ও মালিকদের কেউই এগিয়ে আসে না।
চরফ্যাশন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মো. মারুফ মিনার জানান, জেলেদের উদ্ধারে সাগরে যাওয়ার মতো যানবাহন নেই। তারপরও জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতার পাশাপাশি আইন প্রয়োগ করা হবে।