নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না: সংলাপে বক্তারা
গাজীপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৩, ০৬:৫৩ পিএম
গাজীপুর সিটি নির্বাচন-২০২৩-এ ‘প্রত্যাশা ও করণীয় শীর্ষক’ নাগরিক সংলাপে অধিকাংশ মেয়র প্রার্থী সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। তারা অভিযোগ করে বলেন, গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি। মন্ত্রী-এমপিরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে তাদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করছেন।
বুধবার সকাল ১০টায় গাজীপুর প্রেস ক্লাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এ সংলাপের আয়োজন করে। সুজনের গাজীপুর জেলা সভাপতি আমজাদ হোসেনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক ইস্তেখার শিশিরের সঞ্চালনায় বক্তব্য দেন মেয়র প্রার্থীরা।
সিটি করপোরেশন থাকবে দুর্নীতিমুক্ত: আজমত উল্লা
আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট মো. আজমত উল্লা খান বলেছেন, সিটি করপোরেশন অ্যাক্ট ২০০৯ তার যতগুলো ধারা আছে, আইন বা বিধিমালায় যা রয়েছে হুবহু আমি তা প্রতিপালন করব। আমি আসতে পারলে সিটি করপোরেশন দুর্নীতিমুক্ত থাকবে। এ বিষয়ে আমি আপনাদের শতভাগ নিশ্চিত করতে পারি।
তিনি বলেন, গত ১০ বছরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের একটি অর্গানোগ্রাম হয়নি। অর্গানোগ্রাম বা সার্ভিস রুল ছাড়া একটি সিটি করপোরেশন চলছে। এটা কখনো হতে পারে না। আপনাদের সহযোগিতায় আল্লাহ যদি আমাকে তৌফিক দেয় ছয় মাসের মধ্যে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জন্য একটি অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হবে।
তিনি আরও বলেন, গাজীপুর সিটি করপোরেশন গড়ার পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ যাবতকালে একটি প্রকল্পেই তিনি সাতশ কোটি টাকা দিয়েছেন, একটি প্রকল্পে প্রাথমিক পর্যায়ে ১ হাজার ৫১০ কোটি পরবর্তীতে এটা বেড়ে ১ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা হয়েছে। আরও একটি প্রকল্প একনেকে পাশ করে তিনি তিন হাজার ৮২৮ কোটি টাকা দিয়েছেন। ময়লা আবর্জনা এবং ট্রাক, বাসস্ট্যান্ড করার জন্য ৭৮২ কোটি টাকা দিয়েছেন। এই টাকাগুলো দেওয়ার যে, সময়সীমা ছিল তার অনেকটা সময় সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। শুধুমাত্র অদক্ষতার কারণে বা অন্য কোনো কারণে এটি বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি।
আজমত উল্লা খান বলেন, আমি যখন টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলাম তখন একজন নাগরিক তার কাজের জন্য কোনো বিষয়ে কার টেবিলে যেতে হবে, তাকে কত টাকা দিতে হবে এবং কত দিনের মধ্যে তিনি সেবাটি পাবেন- এমন ২৯টি বিষয় উল্লেখ করে একটি বিশাল সাইনবোর্ড লাগিয়ে ছিলাম। যাকে নাগরিক চার্টার হিসেবে বলতে পারেন। এ জিনিসগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আমি যদি আসতে পারি তবে সিটি করপোরেশনের হেড অফিসসহ প্রতিটি জোনে পুনরায় এ ব্যবস্থা চালু করব।
তিনি বলেন, শুধু নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলর দ্বারা যদি সিটি করপোরেশন পরিচালিত হয় তবে সেটি হবে একটি অকার্যকর সংস্থা। কোনো অবস্থাতেই এ সংস্থার মাধ্যমে জনগণের উপকার করা যাবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না সংস্থাগুলোতে সিটিজেনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা না যায়। আপনারা খোঁজ নিয়ে জানবেন আমি যখন টঙ্গী পৌরসভার মেয়র ছিলাম তখন নাগরিকদের অংশগ্রহণে একটি কমিটি করেছিলাম। আমার সাথে যারা মেয়র বা চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন আমি তাদের সবাইকে ওই কমিটিতে সদস্য করেছিলাম। পরবর্তীতে এটির সূত্র ধরে আইনে পরিণত হয়েছে।
সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না: শাহনুর ইসলাম
সংলাপ অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী সরকার শাহনূর ইসলাম রনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তবেই প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারবেন। নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হলে নাগরিকদের প্রত্যাশা পূরণ হবে না।
তিনি বলেন, বিগত ২০১৮ সালের গাসিক নির্বাচনে কতটুকু দুর্নীতি ও অনিয়ম হয়েছিল তা সবাই জানেন। ওই নির্বাচনে আমার বড় চাচা বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসান উদ্দিন সরকার মেয়র প্রার্থী হয়েছিলেন। প্রশাসন দিয়ে কেন্দ্র দখল করে এবং ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে তার সুনিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। বেলা ১১টার পর ধানের শীষের এজেন্টদের ভোট কক্ষ থেকে বাহির করে দেওয়া হয়েছিল। ডিবি পুলিশ দিয়ে কেন্দ্র থেকে এজেন্টদের ধরে নিয়ে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন জেলায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন অনেক এজেন্টের পকেটে টাকাও ছিল না। তাদের মানুষের কাছে ভিক্ষা করে গাড়ি ভাড়া সংগ্রহ করে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। এবারের নির্বাচনেও যাতে এমন পরিস্থিতি না হয় সেজন্য তিনি সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
শাহনূর ইসলাম রনি বলেন, আমরা যারা প্রার্থী হয়েছি তারা কেউ নিজেদের ব্যক্তি স্বার্থের জন্য প্রার্থী হয়নি। শুধু নগরবাসীর স্বার্থে একটি সুন্দর নগরী গড়ার প্রত্যয়ে আমরা প্রার্থী হয়েছি। নগরীর সবার সমস্যা সামনে রেখেই আমরা নির্বাচনী ইশতেহার প্রস্তুত করব। নাগরিকদের চাহিদাগুলো সামনে রেখে যেভাবে নগরীকে সাজালে সুন্দর হয় সেভাবেই সবার সহযোগিতা নিয়ে নগরীকে সুন্দরভাবে সাজাব।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি: গাজী আতাউর রহমান
সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত মেয়র প্রার্থী গাজী আতাউর রহমান বলেন, সিটি করপোরেশন কোনো স্বাধীন সংস্থা নয়। কেন্দ্রীয় সরকার না চাইলে এখানে মেয়ররা কিছু করতে পারেন না। গাজীপুর সিটি করপোরেশন ভালো চলুক তা কেন্দ্রীয় সরকারই চায় না। গাসিকের প্রথম মেয়র অধ্যাপক এমএ মান্নানকে জেলে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তাকে দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। বর্তমান মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে তার দায়িত্ব পালন করতে দেওয়া হয়নি। তার কান্নাকাটি দেখেই বোঝা যায় তার সঙ্গে কী হয়েছে।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে এখনো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি অভিযোগ করে তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা সরকারি সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে তাদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা করছেন।
আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীকে উদ্দেশ্য করে গাজী আতাউর রহমান বলেন, আজমত উল্লা খান বলছেন- নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনকে দুর্নীতিমুক্ত করবেন। কিন্তু তিনি দুর্নীতিমুক্ত নির্বাচন চান কিনা সেটি আগে তাকে নিশ্চিত করতে হবে। ভোটাররা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে যেতে পারবেন কিনা, সুষ্ঠুভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কিনা, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকবে কিনা এখনো যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
গাজী আতাউর রহমান আরও বলেন, নদীর এপার আর ওপাড়ের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। উত্তরা থেকে তুরাগ নদী পার হলেই গাজীপুর নগরী কতটুকু অবহেলিত তা দেখলে আর বলার অবকাশ রাখে না। এ পাড়ে দীর্ঘ দিন যাবত যারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেছেন তারা একটি পরিকল্পিত নগরী গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন। এ নগরীকে তারা সভ্য সমাজের বসবাসের অযোগ্য করে ফেলেছেন। এ শহরের সম্পদের মালিকরা এখন নিজ এলাকা ছেড়ে ভাড়ার টাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে উত্তরায় বসবাস করছেন। শিল্প অধ্যুষিত এ নগরীর শিল্প মালিকরাও গাজীপুরের পরিবেশ আরও ভালো হোক তা তারা চান না। তারা আধুনিক সুযোগ সুবিধায় উত্তরা ও ধানমন্ডি এলাকায় বাস করেন। আর তাদের শ্রমিকরা শিল্পবর্জ্যে দূষিত এ নগরীর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করেন।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর জন্য, পুলিশের জন্য, সরকারি কর্মচারীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল আছে কিন্তু পুঁজিবাদী এ সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের জন্য আলাদা কোনো হাসপাতাল নেই। তিনি নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনের অর্থায়নে গাজীপুর নগরীর শ্রমিকদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করে ফ্রি চিকিৎসা ও শ্রমিকদের সন্তানদের ফ্রি লেখা পড়ার ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এদিকে সুজনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গাজী আতাউর বলেন, সংলাপে সব প্রার্থীকে কথা বলার সমান সুযোগ দেওয়া হয়নি। অন্য প্রার্থীদের ৫ থেকে ১০ মিনিট কথা বলার সুযোগ দিয়েছে আর আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীকে প্রায় ১৮ মিনিট কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুজন সবার প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি, সমান সম্মান ও সমান সুযোগ না দিলে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের কাছ থেকেও সমান সুযোগ আশা করা যায় না।
তিনি ইনসাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে বলেন, সামাজিক সংকট দূর করতে হলে মানুষের মনে স্পিরিচ্যুয়াল পরিবর্তন আনতে হবে। দলীয় বিভক্তি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে যেন ছড়িয়ে না পড়ে যে জন্য সকল ভালো মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
সুজন আয়োজিত নাগরিক সংলাপে আরও বক্তব্য রাখেন- স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন মণ্ডল, মো. হারুন-অর-রশিদ, জাকের পার্টির মেয়র প্রার্থী রাজু আহমেদ, গণফ্রণ্টের আরিফুল ইসলাম। বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও সুজনের কেন্দ্রীয় সদস্য রোবায়েত ফেরদৌস, সমন্বয়ক দ্বীলিপ সরকার। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জেলা শাখার সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট সুনিল কুমার সরকার।
নাগরিকদের পক্ষে প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন- সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ গাজীপুরের প্রতিনিধি অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান আকাশ, গাজীপুর ইমাম সমিতির প্রতিনিধি মাওলানা মো. আবু বকর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ গাজীপুরের আনোয়ারা বেগম, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার সমিতির হাজী আব্দুস সালাম, গাজীপুর নাগরিক কমিটির অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন, নদী বাঁচাও আন্দোলন গাজীপুরের অ্যাডভোকেট আনোয়ার হোসেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ গাজীপুরের ফ্রেডরিক মুকুল বিশ্বাস, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জিয়াউল করিম প্রমুখ।
ইভিএমে ভোট হবে ৪৮০ ভোট কেন্দ্রে
আগামী ২৫ মে আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৫৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৪৮০টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। থাকবে সিসি ক্যামেরা।
গাজীপুর জেলা নির্বাচন অফিসার এএইচএম কামরুল হাসান জানান, গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের জন্য মোট ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৮০টি। এসব কেন্দ্রে মোট ভোট কক্ষ থাকবে তিন হাজার ৪৯৭টি। এতে অস্থায়ী ভোটকক্ষ থাকবে ৪৯১টি।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে সর্বশেষ হালনাগাদকৃত ভোটার সংখ্যা ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৭৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার পাঁচ লাখ ৯২ হাজার ৭৬২ জন, মহিলা ভোটার পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৬ জন এবং হিজড়া ভোটার সংখ্যা ১৮ জন। নির্বাচন পরিচালনায় প্রিসাইডিং অফিসার থাকবে ৪৭৯ জন, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার থাকবে তিন হাজার ৪৯৭জন, পোলিং অফিসার ছয় হাজার ৯৮৪ জনসহ মোট ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা থাকবে প্রায় ১২ হাজার।